রফিক উদ্দিন বাবুল, উখিয়া :
ইউএনএইচসিআর এর তথ্য মতে উখিয়া টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের অধিকাংশ কর্মহীন, বেকার রোহিঙ্গা। চাহিদা পূরণ করতে তারা ইয়াবার বিনিময়ে সংগ্রহ করছে মারাত্মক অস্ত্র। এসব অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবা ও স্বর্ণের বার। এসব অবৈধ মালামালের কর্তৃত্ব ও ভাগাভাগি নিয়ে ক্যাম্পে প্রায় সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ লেগে যায়।
গত এক মাসে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ক্যাম্পে প্রায় ১০ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে বলে ক্যাম্পে দায়িত্বরত মাঝিরা জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে থানায় বেশ কয়েকটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মধ্যে কিছু কিছু চালান আটক করতে সক্ষম হলেও বেশির ভাগ চোরাচালানের অংশ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেকার এসব রোহিঙ্গা কর্মসংস্থানের আওতায় আনা না হলে সহিংসতা আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল।
সীমান্ত দিয়ে অবৈধ মাদক, অস্ত্র ও স্বর্ণ পাচার করতে গিয়ে গত তিন মাসে শুধু বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হাতেই আটক হয়েছেন উখিয়া টেকনাফের উদ্বাস্তু শিবিরের অন্তত ২০ রোহিঙ্গা। তৎমধ্যে আটক আটজন রোহিঙ্গা কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান থেকে অদূরে তাদের অবস্থান হওয়ায় এখানে প্রায় সময় অপহরণ, খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস নিয়ে গড়ে উঠা কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ আনতে পুলিশ বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ক্যাম্পে বিভিন্ন ঘটনায় ও বন্দুকযুদ্ধে ১০ জন রোহিঙ্গা মৃত্যুর পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীরাও নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পটিতে নিয়মিত সহিংস ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পের দায়িত্বরত কয়েকজন মাঝি।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান একে জাহাঙ্গীর আজিজ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উখিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা সংলগ্ন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নে বৃহত্তর জায়গা নিয়ে উখিয়া ও ঘুমধুমের অবস্থান। ঘুমধুম ইউনিয়নের দক্ষিণ পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ। চোরাকারবারিদের জন্য এ স্থানটি অত্যন্ত পরিচিত এবং সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার সুবাদে রাখাইন হয়ে তুমব্রু আবার তুমব্রু হয়ে সরাসরি ঘুমধুম, বালুখালী তথা বিভিন্ন ক্যাম্পে সরাসরি আশ্রয় নেওয়া সম্ভব বিধায় এ পথে বর্তমানে ইয়াবা ও স্বর্ণেরবার পাচার হয়ে আসছে। তাছাড়া এখানে রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় একটি জনগোষ্ঠী মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এসব অপরাধীর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সর্বাক্ষণিক তৎপরতায় রয়েছে বিজিবি সদস্যরা। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক আলী হায়দার আজাদ বলেন, বিজিবি’র দুঃসাহসিক অভিযান ও নিরন্তর প্রহরার কারণে চোরাচালানিরা অনেকটা থমকে গেছে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ১ নভেম্বর রাতে বিজিবির ঘুমধুম বিওপির সদস্যরা উখিয়ার পালংখালীর কুড়ারপাড়া এশিয়ান হাইওয়ে থেকে মো. কলিম নামের একজন রোহিঙ্গার দেহ তল্লাশি করে ৪৭১ ভরি ৯ আনা ৪ রতি ওজনের ৩১টি স্বণের্র বার ও বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণালংকার উদ্ধার করেন। আটককৃত রোহিঙ্গা কলিম বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮, ব্লক-বি/৪৭-এর কবির আহমেদের ছেলে। ঘুমধুম বিজিবি আটকের পর তাকে উখিয়া থানা পুলিশের নিকট সোপর্দ করে।
গত ৫ নভেম্বর সকাল ৮টায় দুই লাখ পিস ইয়াবাসহ ছয়জনকে আটক করে। এরমধ্যে পাঁচজনই কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১-এর বাসিন্দা। ইয়াবা পাচারের ঘটনায় এদের নেতৃত্বে ছিলেন উখিয়ার থাইংখালী গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন। তিনিও বিজিবির হাতে আটক হন। এছাড়া রেজু আমতলী বিজিবি’র একটি বিশেষ আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় প্রায় ৬ কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার করে। এসময় বিজিবি’র অবস্থান লক্ষ্য করে চোরাচালানিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এছাড়া নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে আরো ৪৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী মারা গেছেন। এ দুই বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৪৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক সংক্রান্ত। তাছাড়া মানব পাচারের অভিযোগে চারটি মামলাসহ অস্ত্র, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, নারী নির্যাতন, অপহরণ ও পুলিশের ওপর হামলার মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, ক্যাম্পভিত্তিক মাদক ব্যবসা রোহিঙ্গা অর্থের একটি বড় উৎস। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ক্যাম্পে মজুদ করে এখান থেকেই হাতবদলের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবার চালান। পাশাপাশি ইয়াবার বাহক দিয়ে টাকা ও মাদকের বিনিময়ে অস্ত্র সংগ্রহ পূর্বক ক্যাম্পের প্রভাবশালী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অপতৎপরতার মাধ্যমে ক্যাম্পে অস্থিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে আসছে।
গত ২ অক্টোবর কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে পালংখালীতে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলি এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আহমেদ সনজুর মোরশেদ জানান, ক্যাম্পের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে নগণ্য পুলিশ লোকবল নিয়ে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও মাদক পাচার প্রতিরোধে পুলিশ সার্বক্ষণিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।