অবন্তী বহ্নিশিখা »
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এদেশে তখন একটি রাজপরিবার বাস করত যাদের একটি ছোট্ট এবং লক্ষ্মী মেয়ে ছিল। মেয়েটির নাম অরণি। তার পাঁচ ভাই। সজল, নিখিল, স্বপ্নীল, তূর্য এবং সিদ্ধার্থ। কিন্তু অরণির যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখনি তার মা মারা গেলেন। তার এক বছর পর অরণির বাবা আরেকজনকে বিয়ে করলেন। সে দেখতে খুব সুন্দর হলেও তার একটি ভয়ঙ্ককর গোপন বিষয় ছিল। সে আসলে ছিল একটি ডাইনি! বাইরে সে তার ছেলেমেয়েকে আদর করলেও ভিতরে ভিতরে সে তাদেরকে ঘৃণা করত। নতুন রাণী শপথ করল যে, সে তার নতুন ছেলেমেয়েদেরকে যেকোনোভাবে তাড়িয়ে দেবে।
কিছুদিন পরে যখন রাজপুত্ররা বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিল, নতুন রানি তাদেরকে জাদু করে পাখি বানিয়ে দিল। আর সেই সঙ্গে এমন জায়গায় পাঠাল যেখান থেকে তারা কোনোদিনও প্রাসাদে ফিরতে পারবে না। কিন্তু রানি মন্ত্র একটু ভুল পড়ায় তারা প্রতি রাতে বারোটার পর আবার মানুষ হয়ে যেত। পরদিন রাণী সবাইকে বলল যে রাজপুত্ররা পালিয়ে গেছে।
এই ঘটনার পরে শুধু বাকি ছিল অরণি। একদিন রানি অরণির গোসলঘরে গিয়ে কিছু পোকা তার গোসল করার জায়গায় রেখে দিল আর কিছু মন্ত্র পড়ল যা অরণিকে খুব বিচ্ছিরি একটা মেয়ে বানিয়ে দেবে । অরণি গোসল করার পর ঠিক তাই হলো। কিন্তু ও তো নিজেকে আয়নায় না দেখেই তার বাবার কাছে চলে গিয়েছে। রাজা অরণিকে দেখে চিনতেই পারলেন না ঐ পোকাগুলোর জন্য। উল্টো অরণিকে তিনি বাইরের কেউ ভেবে তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু এবারেও রানি ভুল মন্ত্র পড়ায় অরণি যখন নদীতে মুখ ধুলো তখনই সে তার আগের রূপ ফিরে পেল। তারপরও রাজা তাকে এভাবে দূর করে দেওয়ায় সে কাঁদতে কাঁদতে প্রাসাদ থেকে অনেক দূরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেল একঝাঁক পাখি নিচে নেমে তার দিকেই আসছে। তখন যেই রাত বারোটা বাজল আর অরণি দেখতে পেল সেই পাখিগুলো একে একে তার ভাই হয়ে গেছে! সে বিস্মিতভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল আর রাজপুত্ররা ছুটে এসে অরণিকে জড়িয়ে ধরল। অরণি তার ভাইদের প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার গল্পটা খুলে বলল এবং তার ভাইরাও তাকে খুলে বলল তাদের পাখি হওয়ার কারণ। এরপর থেকে ওরা সবাই একসাথে থাকত। তাদের দিনগুলো ভালোই কাটতে লাগল। কিন্তু একদিন অরণি স্বপ্নে দেখল যে একটা পরি হাতে একটি কাঁটাওয়ালা পাতা নিয়ে এসে তাকে বলছে, “অরণি, দুষ্টু রানির জাদু ভাঙার একমাত্র উপায় হলো কাঁটাওয়ালা পাতার তৈরি জামা পরিয়ে দেয়া। অর্থাৎ, তুমি যদি তোমার ভাইদের আবার মানুষ বানাতে চাও, তাহলে এই পাতাগুলো দিয়ে সেলাই করে তোমাকে জামা বানাতে হবে তোমার ভাইদের জন্য। কিন্তু মনে রেখ, জামা বানানো শুরু করার পর তোমার ভাইয়েরা মানুষ রূপ পাওয়ার আগে কোনো শব্দ করা যাবে না। কোনো আওয়াজ করলে সারাজীবনের জন্য তোমার ভাইয়েরা পাখি থেকে যাবে।” এরপরই অরণির ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নটি সত্যি নাকি, তা জানার জন্য সে তার ভাইদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা মত দিল যে স্বপ্নটা সত্যি। তাই অরণি আর দেরি না করে সেই পাতাগুলো খুঁজতে বের হলো। সে কোথাও খুঁজে পেল না পাতাগুলো। হঠাৎ সে দেখল একটা প্রাসাদের বাগানে অনেকগুলো কাঁটাসহ পাতা। কোনো উপায় না পেয়ে অরণি সেখান থেকেই নিল। এভাবে সে একটা জামা বানিয়ে ফেলল। তার হাতে অনেক কাঁটা ফুটে গেল কিন্তু সে কোনো আওয়াজ করল না। এরপর একদিন যখন অরণি বাগান থেকে কাঁটাওয়ালা পাতা তুলছিল তখন রাজপুত্র সেটা দেখে বলল, “তুমি আমার বাগান থেকে এগুলো চুরি করছো কেনো?” অরণি কিছু বলতে পারল না কিন্তু সে রাজপুত্রের দিকে তাকানোর পর রাজপুত্র তার সৌন্দর্য দেখে অরণিকে শাস্তি দেওয়ার মত পাল্টিয়ে বলল, “তুমি তো দেখছি কথা বলতে পারো না। তাহলে আমি তোমাকে আমার কাছে রাখব।” অরণি মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝানোর চেষ্টা করলেও রাজপুত্র তাকে নিয়ে গেল।
এভাবে আরও অনেকদিন কেটে গেল। আস্তে আস্তে দুজনের দুজনকে ভালো লেগে গেল। তাই একদিন রাজপুত্র অরণিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?” অরণি হাসল এবং মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলার চেষ্টা করল। তখনই রাজপুত্র তার বাবাকে বিয়ের সব আয়োজন করতে বলল। কিন্তু অরণিকে কাঁটাওয়ালা পাতা সেলাই করতে দেখে রাজা ভাবত সে একটা ডাইনি। তাই রাজা এ বিয়েতে রাজি হলো না।
এরমধ্যে অরণি প্রায় সবগুলো জামা বানানো শেষ করল। শেষের জামার হাতা বানাতে আরও কিছু কাঁটাওয়ালা পাতা লাগত। তাই সে মাঝরাতে বাগানে সেই পাতাগুলো তুলতে লাগল। তখন রাজা সেটা দেখে ভাবল, “একমাত্র একটা ডাইনিই এত রাতে কাঁটাওয়ালা পাতা ছিঁড়বে।” এই ভেবে সে তাড়াতাড়ি অরণিকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দিল। পরদিন ঠিক হলো যে অরণিকে মেরে ফেলা হবে! রাজপুত্রের তো দুঃখের কোনো শেষ নেই কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। তবুও অরণি হাল না ছেড়ে শেষ জামাটা বানিয়ে ফেলল।
পরদিন অরণিকে যখন মারার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন অনেকগুলো পাখি উড়ে এলো আর অরণি জামাগুলো তাদের পরিয়ে দিল। তারপর সবাই অবাক হয়ে দেখল যে পাখিগুলো মানুষ হয়ে যাচ্ছে। রাজপুত্র এসে অরণিকে বলল, “আমি জানি না এখানে কী হচ্ছে। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে পুরো ঘটনাটা শুনতে পারি যদি তুমি এখনো আমাকে বিয়ে করতে চাও।”
এরপর অরণি এবং রাজপুত্রের ধুমধাম করে বিয়ে হলো।
(ঞযব ঝধিহ চৎরহপবংং থেকে ভাবানুবাদ)