পঙ্কজ শীল »
অয়ন্তিসোনা নামটা শুনেই বোঝা যায় সে খুব আদরের মেয়ে। তার গোলগাল মুখ, খটখটে হাসি আর ঝিনুকের মতো দাঁতের সারি দেখলেই মনে হয়, এ মেয়ে নিশ্চয়ই কোনো কার্টুন থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু না, অয়ন্তিসোনা একেবারে আসল, মানে মাংস আর হাড়ের।
সে থাকে শহরের এক ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে, তবে তার মনে রাজপ্রাসাদের মতো বড়ো কল্পনার বাড়ি। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো একটা লাল টেডিবিয়ার। নাম রেখেছে টিপটিপু। টিপটিপুর লাল গায়ে সাদা ফিতে বাঁধা, আর তার চোখ দুটি যেন সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে অয়ন্তির মুখের দিকে।
অয়ন্তি যখন স্কুলে যায়, টিপটিপু তখন থাকে বিছানার এক কোণে। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরেই সে চিৎকার করে ওঠে, “টিপটিপু! আমি এলাম!” তারপর শুরু হয় ওদের দারুণ সব খেলা। কখনও তারা যায় মঙ্গলগ্রহে, কখনও পাতালপুরীতে রাজা হতে।
একদিন বিকেলে মা বলল, “অয়ন্তি, আজ কিন্তু টিপটিপুকে নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। পার্কে যাবে তো, দাগ লাগলে কিন্তু ধুতে হবে!”
অয়ন্তি ফোঁস করে বলল, “টিপটিপু তো কখনও দাগ লাগায় না। ও খুবই ভদ্র টেডি। প্লিজ মা, একটুখানি নিয়ে যাই!”
মা চোখ পাকালেন, “তবে সাবধানে, খেয়াল রেখো ও যেন পড়ে না যায়।”
পাশের পার্কে আজ বেশ ভিড়। অয়ন্তি দোলনায় বসেছে, আর টিপটিপু তার কোলে। হঠাৎ এক ছেলে এসে বলল, “এই টেডিটা দাও তো, আমি একটু দেখি।”
অয়ন্তি মাথা নাড়ল, “না, এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। অন্য কেউ ধরতে পারবে না।”
ছেলেটা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল।
কিন্তু মুশকিল শুরু হলো তখন, যখন অয়ন্তি একটা আইসক্রিম খাওয়ার জন্য দাঁড়ালো, আর হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন বাতাসের ঝাপটা এসে টিপটিপুকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
“টিপটিপু!” অয়ন্তি চিৎকার করে উঠল।
পার্কজুড়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। মা তো রীতিমতো উদ্বিগ্ন, আর অয়ন্তির মুখে তখন অশ্রু-গঙ্গা। “টিপটিপু হারিয়ে গেছে! এখন আমি কাকে বলব, আজকে স্কুলে বকুনি খেয়েছি!”
হঠাৎ এক বৃদ্ধ চাচা এলেন, হাতে একটি লাল টেডিবিয়ার। “এইটা কি তোমার?”
অয়ন্তির চোখ চকচক করে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ! এটা টিপটিপু! ওর গায়ে এই ছোট্ট দাগটা আছে, আমিই দিয়েছিলাম চিপস খেতে খেতে।”
চাচা হাসলেন, “এই টেডিবিয়ারও বোধহয় কান্না করছিল। আমি তো রাস্তার ধারে ওকে কুড়িয়ে পেয়েছি। তখনই বুঝলাম, কোনো আদরের ছোট্ট মেয়ে ওকে খুঁজছে।”
অয়ন্তি ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে, টিপটিপুকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
সে রাতে অয়ন্তির ঘুম এল খুব মিষ্টি। স্বপ্নে সে আর টিপটিপু উড়ছে রঙিন বেলুনে চড়ে। তারা যাচ্ছে এক বিশাল টেডিবিয়ার রাজ্যে। সেখানে টিপটিপু রাজা, আর অয়ন্তি তার প্রধানমন্ত্রী। নিয়ম হচ্ছে রোজ একটা গল্প শোনা বাধ্যতামূলক, আর দুধ না খেলে চকলেট মিলবে না!
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই অয়ন্তি বলল, “মা, আজকে আমি টিপটিপুকে নিয়ে স্কুলে যাব। ও তো আমার জীবনের সবচেয়ে সাহসী বন্ধু!”
মা হাসলেন, “ঠিক আছে, তবে আজ ওকে ব্যাগে রাখো। ক্লাসে কিন্তু টেডি দিয়ে পড়া হবে না!”
স্কুলে গিয়েই বন্ধুরা জড়ো হয়ে গেল, সবাই টিপটিপুকে দেখতে চায়। কেউ বলল, “ও তো একেবারে রাজার মতো দেখায়!”
অয়ন্তি গর্বিতভাবে বলল, “ও সত্যিকারের রাজা! আমাকে একবার একটা কুমিরের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।”
বন্ধুরা তো অবাক, “কীভাবে?”
অয়ন্তি বলল, “সেই গল্প পরে বলব। আগে ৎবপবংং এ টিপটিপুর জন্য বিস্কুট জোগাড় করতে হবে।”
এইভাবেই চলতে লাগল অয়ন্তিসোনা আর তার লাল টেডিবিয়ারের মজার দিনগুলো। তারা একসাথে খেলত, ঝগড়া করত, আবার রোজ রাতে ঘুমানোর আগে একটা করে নতুন গল্প বানিয়ে বলত। টিপটিপু নাকি সব গল্প মন দিয়ে শোনে, আর চোখ টিপে সম্মতি দেয়।
মাঝেমাঝে অয়ন্তি ভাবত, যদি টিপটিপু হঠাৎ করে সত্যি কথা বলতে পারত! তাহলে হয়তো বলত “তুমি যত বড় হও, আমাকে ভুলে যেও না।”
কিন্তু অয়ন্তি জানে, যত দিন সে থাকবে, টিপটিপুও তার সঙ্গে থাকবে। হয়তো বড় হয়ে গেলে সে টিপটিপুকে আলমারিতে তুলে রাখবে, কিন্তু একেকটা দুঃখের রাতে ঠিক বের করে আনবে।
আর বলবে, “টিপটিপু, আজ একটু জড়িয়ে থাকো তো, মনটা ভালো নেই।”
আর টিপটিপু, সে তো শুধু একটা লাল টেডিবিয়ার নয়, সে অয়ন্তির শৈশবের সবচেয়ে বড় সাহস আর আনন্দের প্রতীক।