নিজস্ব প্রতিবেদক »
রমজান উপলক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার একাধিক ঘোষণা ও হুঁশিয়ারি দিলেও তা কোনভাবে কার্যকর হচ্ছে না। একের পর এক বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। রমজানে বাড়তি চাহিদা থাকে এমন প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে আমিষ খাবার মাছ, মাংস, ডিমসহ সকল ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির বাজারে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে। নিত্যপণ্যের এমন দামবৃদ্ধিতে হা-হুতাশ বেড়েছে সাধারণ মানুষদের।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিন বাজার ও বক্সিরহাট কাঁচা বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, ইফতার সামগ্রী ছোলা-ডালের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাজারে সকল ধরনের মাংস, মাছ ও ডিমের দাম আবারো বেড়েছে। তবে সকল ধরনের সবজির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে স্থিতিতে থাকলেও ইফতারের বেগুনির মূল উপাদান বেগুনের দাম বাড়তি। বাজারে এ দিন গোল বেগুন বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে, সবুজ বেগুন ৭০ টাকায়, মোটা বেগুন ৮০ টাকায়, আর বেগুনিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া লম্বা বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে। তাছাড়া গত এক সপ্তাহ ধরে শরবতের ‘অপরিহার্য’ উপাদান লেবুর দাম সবচেয়ে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। গতকাল বক্সিরহাটে প্রতি পিছ লেবু বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকায়। যার ডজনে দেড়শো ছাড়িয়েছে।
সবজি বিক্রেতা মো. রুবেল বললেন, রেযাজউদ্দিন বাজারে লেবু কিনতে গেছি, সেখানে ১ শ পিচ লেবু বিক্রি করছে ১ হাজার টাকায়। আমরা ডজনে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করছি।
তাছাড়া বাজারে পর্যাপ্ত শীতকালীন সবজির যোগান থাকাতেই সপ্তাহের ব্যবধানে অনান্য সবজির তেমন দাম বাড়েনি। গতকাল বাজারে শসা প্রতি কেজি ৫০ টাকা, টমেটো ২০ টাকা, কাঁচামরিচ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
বক্সিরহাট বাজারে সবজি ক্রয় করতে আসা খাস্তগীর স্কুলের শিক্ষিকা ইসমা বলেন, এবার রমজানে সবজির বাজার কিছুটা কম থাকলেও মাছ, মাংস, ডিমসহ সকল ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। দেশে কোনো জিনিসের দাম বাড়লে সেটা আর কমে না। আয়ের সঙ্গে মিল রেখে চলতে গিয়ে মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন কি আর শাকসবজি খেতে ইচ্ছে করে? আমরা বা সবজি খেলাম কিন্তু বাড়ির বাচ্ছারা তো আমিষ জাতীয় খাবার মাছ ও মাংস খেতে চায়। গত এক সপ্তাহ আগে মাছ কিনছি। কিছু সবজি কিনে বাড়ি ফিরছি। আয়ের সাথে সমন্বয় করে চলতে হচ্ছে।
এদিকে রমজানের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই সকল ধরনের খেজুরের কৃত্রিম সংকট, আমদানি দাম বৃদ্ধির ইস্যু দেখিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে প্রশাসন অভিযান চালানোর পরও কোনভাবে কমছে না খেজুরের দাম। পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়েছে খেজুরের, যার প্রভাব পড়েছে, খুচরা বাজারেও।
গতকাল খাতুনগঞ্জে খেজুর কিনতে আসা ক্রেতা আবদুর রহমান বলেন, প্রতিবছর রমজান আসলে ব্যবসায়ীরা নানা ইস্যু দেখিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবে। ঠিক এবারো আমদানি খেজুর এখনো প্রায় বাজারে আসেনি বলে দাম বাড়িয়েছে। পাইকারি বাজার আর খুচরা বাজারে কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা পার্থক্য রয়েছে।
এদিকে এফবিসিসিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, দোকান মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্টদের নানা চেষ্টার কথা বললেও বাজারে তার প্রতিফলন তেমন দেখা যায়নি।
এদিকে পোল্ট্রি খাদ্য, বাচ্চা, গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ইস্যুতে গত দেড় মাস ধরে আমিষের বাজারের অস্থিরতা চলছেই। প্রশাসনের তদারকিতে গত দুইদিন ব্রয়লার মুরগী ও গরুর মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণে আসলেও গতকাল থেকে এসব আমিষের বাজার আবারও চড়া।
গতকাল বক্সিরহাটে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজিতে। যা গত দুইদিন আগে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসে বিক্রি হয়েছিল ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। এই দুদিনের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। তাছাড়া ব্রয়লারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাকিস্থানি সোনালি ও দেশী মুরগির দাম। বাজারে সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৩৭০ টাকা ও দেশী ৬২০ টাকা কেজিতে। তাছাড়া বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে গরুর মাংসের বাজার এখনো চড়া। গতকাল বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকা কেজিতে এবং খাসির মাংস বিক্রি করে ১ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
মুরগির দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহানগর মুরগি ব্যবসায়ী সমিতির দপ্তর সম্পাদক মোজাম্মেল ব্রাদার্সের মালিক মো. মোজ্জাম্মেল হক বলেন, গত দুইদিন আগে আমাদের মুরগি কেনা কম পড়ছিল। গতকাল থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আবারো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে আমাদেরও বাড়তি দামে কিনতে হওয়াতেই বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রশাসন আমাদেরকে অভিযান চালালেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর তেমন নজর দিচ্ছে না। মুরগির দাম কমাতে হলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাঙাশ ছাড়া বাজারে ২৫০ টাকার নিচে কোনো মাছ বিক্রি হচ্ছে না। সমুদ্রের মাছ ধরা বন্ধ থাকাতেই বাজারে সামুদ্রিক মাছের যোগানও কম। যার ফলে সপ্তাহের ব্যবধানে সকল ধরনের মাছের দাম আবারো চড়া। গতকাল বক্সিরহাট বাজারে শিং মাছ বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০ টাকা। প্রজেক্টের রুই ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, মাঝারি সাইজের কাতল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়াও পাঙাশ ১৬০ থেকে ২২০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
বক্সিরহাটের মাছ ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন বলেন, বাজারে মাছের দাম বাড়তি। সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ থাকাতেই প্রজেক্ট বা লেকের মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে মাছের দাম বাড়াতেই ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। আমাদের মাছ কেনাতেই বেশি দাম পড়াতেই অনেক মাছ বিক্রেতারা মাছ বিক্রি আপাতত বন্ধ রেখেছে।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের মাছ বিক্রেতা রিপন দাস বলেন, ফুটপাতে ও ভ্যানের বিক্রেতাদের তো দোকান ভাড়া, কারেন্ট বিল ও অন্যান্য খরচ লাগে না। তাদের শুধু চাঁদা দিলেই হয়ে যায়। ফলে আমাদের তুলনায় তারা একটু কম দামে বিক্রি করতে পারে। ফলে, ক্রেতারা সেই দিকে চলে যায়।