অবহেলিত শিশুদের প্রতি দৃষ্টি দিন

রায়হান আহমেদ তপাদার :

প্রতিভা জন্ম নেয়, কিন্তু তাকে লালন করতে হবে, তার বিকাশের পরিবেশ অনুকূল করে দিতে হবে- তবেই তার কাছ থেকে অতুলনীয় অবদান লাভ করা যাবে। অনুকূল পরিচর্যার সুযোগ না পেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে সব সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গেছে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। এমন শিশুদের একটা বড় অংশ অভিভাবকহীন পথশিশু। যে সকল শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় বিশেষত অধিকারবঞ্চিত পথশিশু, তাদের মৌলিক ও মানবাধিকার বলে কিছু আছে কি? দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত।সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর অনেকেই এসেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে, না হয় জন্ম হয়েছে শহরের কোনো এক জায়গায়। কাজের অভাবে খেয়ে না খেয়ে তাদের রাত কাটে রাস্তার ধারে বা সরকারি স্থাপনার খোলা বারান্দা বা রেললাইনের পাশে। অভিভাবকহীন এসব শিশুর পথচলা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো। পথশিশুদের পারিবারিক বন্ধন বলে কিছু নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা তাদের কপালে কখনো জোটে না। এমনকি শিক্ষা থেকে ঝরেপড়া শিশু এবং পথশিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। ঝরেপড়া রোধ করতে হলে প্রথমে সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। প্রতি বছর শেষে কী কী কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। শিশুদের যেন কোনোভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করতে না পারে এজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ শিশুবান্ধব সংস্থার উন্নয়নকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশে অনেক ছিন্নমূল শিশু রয়েছে যারা দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না।অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের দিন কাটে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার জোগাতে পারে না। তারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এজন্য এসব শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব শিশুর অভিভাবকদের দারিদ্র্যদূরীকরণে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। উন্নত দেশে দেখা যায়, শিশুর সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। তেমনি আমাদের দেশের অবহেলিত শিশুদের সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিলে সমাজে আর কোনো অরাজকতার সৃষ্টি হবে না। মেয়েদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয় বা কলেজে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত হওয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর ওপর নিপীড়নের ঘটনা অভিভাবকদের মনে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করে যা শিক্ষা থেকে ঝরেপড়ার অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার হচ্ছে, ৭ বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহণ খাতে কাজ নিষিদ্ধ।১৬ বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বেআইনি। শিশুদের প্রতি সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাদের কিশোর বয়সেই। এই বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রধানত কিশোরেরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বন্ধ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়।আর এসব কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়।

এছাড়া অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব পথশিশু জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্মে। একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী আছেন, যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করে। অনেক সময় পথশিশুরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। দারিদ্র্যের কারণে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই নানামুখী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কোনো রকমের অসামাজিক কার্য সম্পাদনের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসনসহ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। মনে রাখতে হবে সমস্যা অনন্ত, কিন্তু সমাধানের উপায়ও যথেষ্ট আছে।আমাদের দেশের অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। তারা ছেলে মেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়। এসব শিশুই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যে সময়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা সে সময়ে তাদের কুলি, হকার, রিকশাচালক, শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়। অপরদিকে পথশিশু হওয়ার পেছনে বিভিন্ন নিয়ামক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

যেমন দারিদ্র্য, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা-মা মারা যাওয়া বা বাবা-মায়ের অসচেতনতা অথবা অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে এখন কিছু শিশু পথে দিন কাটায়। ফলে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে সকল কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে। বর্তমান করোনাকাল অতিক্রান্ত হলে এসব পরিবার গুলোর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা করার সক্ষমতা হারাবে-এটাই স্বাভাবিক। দেখার বিষয়, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কারণ এর ওপরই নির্ভর করছে দেশে কতজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। নাকি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে। সরকারের উচিত এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রমে সম্পৃক্তকরণের নিমিত্তে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আর সেটা হতে পারে বিশেষ কোনো সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে। সচ্ছল পরিবারের তুলনায় দরিদ্র পরিবারে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা অনেক বেশি।

অন্য দিকে শহরের চেয়ে মফস্বল এলাকায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও বেশি। এর সাথে অন্যান্য কারণ তো আছেই। তাই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের জন্য সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি এখনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে এসব শিক্ষার্থী ক্রমেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আগামী বছরগুলোতেও এ ঝরে পড়ার হার আরো বাড়তে থাকবে যার দ্বারা এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ বাধাগ্রস্ত হবে। সেইসাথে এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় ও শনাক্তকরণে প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে সমাজের সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসবে না।

যেহেতু দেশের করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে জীবন ও জীবিকার তাগিদে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে; এমন পরিস্থিতিতে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে এলাকাভিত্তিক জরিপ ছাড়া এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বের করা দুরূহ ব্যাপার।অন্যদিকে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধের জন্য শিক্ষকদের, অভিভাবকদের প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে শিক্ষার অভাবে তাদের সন্তানরা কীভাবে পদে পদে শোষণের শিকার হয়। শিক্ষকের যথাযথ ভূমিকা, সহযোগিতা, তত্ত্বাবধান ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিনষ্ট হতে পারে। অপরদিকে একজন শিক্ষকের একটু উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নৈতিক মূল্যবোধের দিকনির্দেশনার ফলে ছাত্রছাত্রী নিজের জীবন গঠন করে শুধু দেশের নয়, সমগ্র মানবতার কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। পরিবার-শিক্ষক সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে।

পরিশেষে বলব, কম-বেশি প্রতিটি মানুষের মাঝেই মেধা ও প্রতিভা সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। তাকে বিকাশের পথ করে দিতে হবে। বিকাশের প্রয়োজনীয় সুযোগ না পেলে অবহেলায় উপেক্ষায় শক্তি-সামর্থ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। নির্জন বনে অনেক সুগন্ধি ফুল ফোটে। শিশুরা হচ্ছে সমাজনামক বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল। এ ধরনের শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে,একটি শিশুর জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত আগামী বংশধরের জন্য একটি ফলপ্রসূ দিক। শিশুদের যদি স্বাভাবিক বৃদ্ধি না ঘটে তাহলে একটি দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যতœ করলেই রতœ মেলে বলে একটি প্রবাদ আছে। সযতœ পরিচর্যায় জীবনে যেমন অনেক ফল পাওয়া যায়, তেমনি প্রতিভা যদি সঠিকভাবে লালিত হয়, তাহলে তার কাছে উল্লেখযোগ্য ফল প্রত্যাশা করা সম্ভব।

 

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

ই-মেইল :  [email protected]