সোমা মুৎসুদ্দী »
পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের তরুণ অপু। ঢাকায় থাকে পড়াশোনার পাশাপাশি ওর শখ ছবি তোলা। হঠাৎ অপুর ইচ্ছে হলো চট্টগ্রামে বেড়াতে যাবে। ওখানে পাহাড়ে, সমুদ্রে ছবি তোলার অনেক অসাধারণ বিষয় পাবে। অন্যদিকে চল্লিশোর্ধ্ব লেখিকা অবনী লেখালেখির পাশাপাশি আবৃত্তিচর্চা করে। ওর নিজের সংগঠন আছে। তাছাড়া প্রায় সময় অবনীকেও ঢাকা আসতে হয় অনুষ্ঠানের জন্য। ওরা দুজনই কমলাপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছে ট্রেনের অপেক্ষায়। দশ মিনিট পর ট্রেন আসলো। ভাগ্যক্রমে দুজনের বসার সিট পাশাপাশি। দুজনই চট্টগ্রাম যাবে। বসার পর অপু খেয়াল করলো তার পাশে বসা মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। মেয়েটির মধ্যে অসাধারণ একটা মায়া আছে। সে আধুনিকা, তবে অবশ্যই পোশাকে বেশ বাঙালিয়ানার ছাপ আছে। হাতে কাঠের চুড়ি, সাধারণ খোঁপা। কানে রুপোর ঝুমকো মেয়েটিকে আরও অনন্য-অসাধারণ করে তুলেছে। অপু মনে মনে ভাবলো, যাই থাকে কপালে আগে পরিচিত হয়ে নিই। সে মনের সব সাহস এক করে পরিচয় জানতেই মেয়েটি বললো, আমি অবনী রায়, চট্টগ্রামের মেয়ে। তবে বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে জন্ম টাঙ্গাইলে। বর্তমানে চট্টগ্রামেই থাকি। প্রায় সময় ঢাকা আসতে হয় অনুষ্ঠানে। লেখালেখি ও আবৃত্তি করি। অপু শুনে বললো, তার মানে আপনি কবি। অবনী বললো, না না। তেমন বড় কেউ নই। লিখতে ভালো লাগে লিখি। অবনী এবার অপুর পরিচয় জানতে চাইতেই অপু বললো, আমি অপু সাহা। পড়ছি সাংবাদিকতা বিষয়ে। পাশাপাশি ছবি তুলতে বেশ ভালো লাগে। তাই মাঝে-মাঝে বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। অবনী হাসলো। বেশ তো চট্টগ্রামে চলুন। ওখানে ছবি তোালার বেশ
উপাদান পাবেন। অপু বললো, এই মুহূর্তে আপনার চেয়ে ভালো কোনো উপাদান খুঁজে পাচ্ছি না। ট্রেন থামলে আপনার কিছু ছবি তুলে দেবো। অবনী বললো, আচ্ছা পাগল তো আপনি। অপু বললো, আপনার মতো অসাধারণ সুন্দরী কেউ পাশে থাকলে পাগল না হয়ে উপায় নেই। তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে আমার পাশে বনলতা নয় তো সেই শিলংয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা বন্যই বসে আছে। দুজনই হো হো করে হাসলো। অপু হঠাৎ বলে উঠলো, একটা বিষয় দেখুন। আমাদের নামের প্রথম অক্ষর কিন্তু ‘অ’ দিয়ে। অবনী বললো, হ্যাঁ। তবে শ্রীমান অপু বাবু আমি মনে হয় আপনার চাইতে অনেকটাই সিনিয়র হবো। অপু বললো, তাতে কি? জানেন তো প্রতিটা বয়সের একটা বিউটি থাকে। আর সুন্দর একটি বন্ধুত্বে বয়সটা কোনো বাধা নয়। যেমন আমি কোনো অনন্যা অর্ষাতে আটকে থাকিনি। কিন্তু আজ চট্টগ্রাম যেতে -যেতে, শ্রীমতি অবনীর কাছে মনে হচ্ছে ঠিক আটকে গেলাম। হঠাৎ অপুর কণ্ঠে গান ‘দিবস-রজনী আমি যেন কার আশায়, আশায় থাকি।’ অবনী বললো বেশ তো গাইছিলেন, থামলেন কেনো? অপু বললো, রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা সবার কাজ নয়। আচ্ছা অবনী, আপনি তো আবৃত্তি করেন। দুটো লাইন শুনতে চাই আপনার কণ্ঠে। অবনী তার নিজের লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করলো
‘আমি হইনি প্রজাপতি। অপুও হয়নি ঘাসফুল’। অপু অবাক হয়ে গেল, এটা কবেকার লেখা। অবনী বললো, আজ থেকে মাসখানেক আগের লেখা। আমি আমার লেখা গল্প ও কবিতার নায়ক, অনিমেষ, অনির্বাণ থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছি। তাই অনেক ভেবে অপু নামটিকে বেছে নিয়েছি। অপু কয়েক মুহূর্তের জন্য কি ভেবে বললো, অবনী তুমি কি এখনও শাড়ি পর। আমি কিন্তু এখনও কবিতা লিখি। অবনী অপুর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। দুটো লাইন কী অসাধারণ করে অপু বললো। সত্যি কী আমাকে নিয়ে বললো। অপু বললো, আমি বরাবর স্বাধীনচেতা মানুষ। কখনও কেউ আমাকে কাছে টানেনি, আমিও টানিনি। বর্তমান সময়ের তথাকথিত অতিআধুনিক কোনও মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়নি। কিন্তু অবনী আজ আপনার সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে আপনার অপেক্ষাতেই এতকাল বসেছিলাম। আমার ধানসিঁড়ি নেই, জলসিঁড়ি নেই। কিন্তু আমার মনসিঁড়ি ছুঁয়ে সত্যি অবনী নামের কেউ আসলো। অবনী বললো, জানেন, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে গিয়ে জীবন থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে ফেলেছি। বাবার পছন্দের অনেক পাত্রকেই ফিরিয়ে দিয়েছি। গত বছর বাবাও মারা গেলেন। এখন আমি আর মা থাকি। কিন্তু অপু আপনার বয়সটা কম, আবেগটা বেশি। তাই সব কিছু সহজভাবে নেন। অপু বললো, জানো অবনী, আমি সব সময় চাইতাম কেউ যদি আমার জীবনে আসে সে যেন আমার চাইতে বয়সে বড় হয়। একজন অপুকে যেন বুঝতে পারে। তার ভালোবাসার ছায়ায় রাখতে পারে। আমার বাবা-মা কেউ নেই। ভাই আলাদা সংসার নিয়ে থাকে। কখনও আমার খোঁজ নেবার প্রয়োজন মনে করে না। অপুর কথাগুলো শুনে অবনী বললো, ঠিক আছে অপু, তোমার দায়িত্ব নিতে পারি, যখন আমরা আপনি থেকে তুমিতে আসলাম। তখন আর অপু থেকে পালানো এত সহজ নয়। অপু বললো, তবে তাই হোক। চলো যাই পাহাড়ে, সমুদ্রে হারাই কবিতা ও কবিতে। অপুর কথা শুনে অবনী ভীষণ হাসলো। তারপর দুজনে একসাথে গান ধরলো, পথহারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি …