যা ভাবছেন বিশিষ্টজনরা
নিজস্ব প্রতিবেদক »
দেশে অপহরণ, গুম, হত্যার টার্গেট হচ্ছে শিশু ও কিশোরীরা। অপহরণজনিত বেশির ভাগ ঘটনার মূল কারণ প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া, পাচার, পূর্বশত্রুতা, মুক্তিপণ আদায় ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ।
মনিটরিং অব ভায়োলেন্স অ্যাগেনিস্ট গার্ল চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ছয় মাসে ৫০ শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪ জনকে। অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ২ জনকে।
অন্যদিকে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৯ জন, বাল্যবিবাহ হয়েছে ২০ জনের, যৌতুকের বলি হয়েছে ১২ জন; যার মধ্যে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে ও একজন আত্মহত্যা করেছে।
ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৬৬টি, এর মধ্যে প্রতিবন্ধী মেয়ে ৩৮ জন, দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৬৭ জনের। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করে ৪ জন। হত্যা করা হয় ১৫ জনকে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক তথ্য অনুযায়ী, ‘২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৭৪০ নারী ও শিশুকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালে ১৮০ জন, ২০২০ সালে ১২৫ জন, ২০১৯ সালে ১৪৭ জন, ২০১৮ সালে ১৪৫ জন, ২০১৭ সালে ১৪৩ জন ও ২০১৬ সালে ১৩২ জন ছিল।
তারা আরও জানায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এ দুই মাসে সারাদেশে ৭০২ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৩২৮ জন কন্যা শিশু ও ৩৭৪ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৩ জন শিশুকন্যাসহ ১৯৪ জন। তার মধ্যে ২৬ জন কন্যাশিশু ও ২০ জন নারীসহ ৪৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৪ কন্যাশিশু ও ১ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
এছাড়া ১৪ কন্যাশিশুসহ ২৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ৮২টি অপহরণ ও পাচারের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৩৩ জন নারী ও কন্যাশিশু।
যেভাবে দেখছেন বিশিষ্টজনরা
বিশিষ্টজনরা এসব ঘটনায় সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাবকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে পুরো সমাজেই অস্থিরতা বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে সমাজে শিশুদের ওপর। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহফুজা রেহানা বেগম ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও অপহরণ বিষয়ে বলেন, ‘ ধর্ষণ ও নির্যাতন আমাদের বর্তমান সমাজের বাস্তবচিত্র। আমাদের মনস্তত্ব অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা চলছে। আসামিরা যে কোন ক্ষমতাবলে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’
আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘শিশুহত্যা, ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ। শুক্রবার এক অপরাধী নিজেই বলেছে ক্রাইম পেট্রোল দেখে সে হত্যার মত ঘটনায় প্ররোচিত হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে যে প্রথমত আমাদের কোমলমতি শিশুদের অপরাধ প্রবণতায় আকাশ সংস্কৃতিও কিছুটা প্রভাব পড়ছে। দ্বিতীয়ত এটি সামাজিক অপরাধ। শিশু ধর্ষণ, শিশু অপহরণ, শিশু হত্যা এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা। এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এসব অপরাধীর দ্রুত চার্জশিট দিয়ে বিচারের আওতায় আনা উচিত।
অনেকের দাবি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে- এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা বলে বিচারহীনতা, এ কথাটিই সত্য নয়। দেশে আইন আছে, আদালত আছে। সাক্ষীদের যখন আমরা ওয়ারেন্ট দিই, ওনাদের অনেকেই সাক্ষী দিতে আসেন না। বাঁশখালী সাধনপুরের শিশুসহ ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় অনেকজন সাক্ষী আছেন। অথচ ১০ বছর পর্যন্ত সাক্ষ্য দিতে আসেন না।
চবি আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সিফাত শারমীন বলেন, ‘অপরাধ তো হচ্ছেই। সেই অপরাধের যদি বিচার না হয় বা বিচারে দীর্ঘসূত্রতা হয় তাহলে এই অপরাধের হার বেড়ে যায়। অনেক ভিকটিমের পরিবার মামলায় যেতে চায় না। কিংবা মামলার বিচারকাজ দীর্ঘ হওয়াতেই ভিকটিমদের পরিবার মামলা বিমুখ হন। এসব কারণে অপরাধীরা সুযোগ পাচ্ছে।’
অপরাধীদের বিচার যদি দ্রুত হয় তাহলে অপরাধের প্রবণতা কিছুটা হ্রাস পাবেন বলে মনে করেন তিনি।
চবি সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকিয়া শারমিন বলেন, ‘আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। আগে মানুষ পরিবার থেকে যে শিক্ষা পেত, সেটি এখন কাজ করছে না। আমাদের সমাজ দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছে। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমানে অপরাধে বেশি ঝুঁকছে তরুণরা। অপরাধীদের চোখে সবচেয়ে বেশি টার্গেট হচ্ছে শিশুরা। কারণ অপরাধ রুখতে বা আত্মরক্ষা করতে শিশুরা শারীরিকভাবে সক্ষম নয়। আমি বলবো মূলত সমাজই এর জন্য দায়ী। তাছাড়া অপরাধীদের বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আইনের ফাঁক-ফোকরে অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তারা অপরাধ করতে সুযোগ পাচ্ছে।’
জানতে চাইলে সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, দেশে শিশুধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে শিশুধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। আমরা এই ধরনের উদ্বেগজনক ঘটনা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সমাজের দায়িত্ব। কারণ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কান্ডারি। শিশুর সুস্থ বিকাশ কীভাবে হবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের নতুনভাবে ভাবা উচিত।