অরূপ পালিত
সাতসকালে কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে আফরোজা বানুর। দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে ছোট ছোট শব্দে। ভেতর হতে ডোরআইয়ে চোখ রাখেন আফরোজা বানু। মেয়ে মিষ্টি আর নাতনি দাঁড়িয়ে। আফরোজা বানু মেয়েকে দরজা খুলে দিয়ে বললেন,
ওমা! নানুভাইকে নিয়ে একটু বস। তোর জন্য চায়ের পানি দিয়ে আসছি। মেয়ের মুখে কোন কথাবার্তা নেই। মুখটা ভার করে রেখেছে।
আফরোজা বানু মতিন সাহেবের উদ্দেশে বলেন, কে আসছে দেখো। আমার সতিন।
একমাত্র মেয়েকে মতিন সাহেব খুবই আদর করেন। মিষ্টি মেয়ে পালকে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, নানুর সাথে দুষ্টুমি করবে না। আর আজেবাজে খাবারের জন্য বায়না ধরবে না।
মা, এখন চা খাবো না। তোমাদের জামাই নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমারও মেডিকেলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।
আফরোজা বানু মেয়েকে নরম গলায় বললেন,
: মা, তোর বাবার জন্য হার্টের ডাক্তারের খোঁজ পেয়েছিলি ?
মেয়ে মিষ্টি চট করে রেগে চোখ লাল করে বললো, তোমাকে বলেছিলাম না মা। বাবার অসুস্থতার কারণ অলসতা। ওনার কোন রোগ নেই। বাবাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করো না তো।
মিষ্টি মায়ের সাথে চেঁচিয়ে বললো, বাবা কোথায়। এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি, না?
: তোর বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কাল সারারাত ঘুমায়নি। ফজরের নামাজ আদায় করে শুয়েছে তো। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
মা, শরীর ভালো না আর বলো না। বাবার বয়সী এখনো অনেক লোক চাকরি করছেন। উনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, শুধু বসে-বসে ঘুমানোর জন্য। বাবা যদি সকালবেলা একটু হেঁটে গিয়ে আমার মেয়েটাকে নিয়ে আসতো, সকালের হাঁটাও হতো, এদিকে আমারও আর অফিস যেতে দেরি হতো না। তোমাদের জামাই সকালে আমার সাথে রাগারাগি করে। এখন বলছে, আমার নাকি আর চাকরি করতে হবে না।
মতিন সাহেব ঘুমের ভান ধরে মেয়ের সব কথা শুনছেন। মনের ভেতর অজানা কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজের মেয়েকে আজ যেন বেশ অপরিচিত লাগছে। অথচ এই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এই মহিলা নিঃসন্তান রয়ে গেছে।
মিষ্টি মাকে বলে, মা, বাবাকে বলো কাল তো শুক্রবার। সকালে একটু বাসায় যেতে। শান্তির হাট থেকে গরুর মাংস আনতে হবে। তোমার নাতনির কাল জন্মদিন। গরুর মাংসের বিরানি খাবে বলেছে। আর আমারও কয়েকজন বান্ধবী ও তাদের জামাই নিয়ে খেতে আসবে।
আফরোজা বানু সাতসকালে মেয়ের ঝাঁজালো কথায় বেশ কষ্ট পেলেন। রাগ সামলে শুধু একবার বললেন,
: যা মা, জামাইয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মেয়ে চলে যাবার পরে আফরোজা বানু মতিনকে ডেকে বলেন, তুমি এতো ঘুমাচ্ছ কেন? শরীর খারাপ করবে। ওঠে আমার নানুর জন্য দোকান থেকে একটা লেক্সাস বিস্কুট এনে দাও। মেয়ে বলে গেছে ওকে যেন কোন আজেবাজে খাবার না দিই।
আফরোজা বানু মেয়েকে তো চেনেন, পান থেকে চুন খসলেই মুখের ওপর কথা শোনাতে দেরি করবে না। পেটে ধরলে কথা বলতে চিন্তা করতো। মেয়ের কথায় আফরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে নিলেন। মনে মনে মতিনকে দোষারোপ করতে লাগলেন।
মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে মতিন সাহেব কোনদিন নিজে একটির ওপর দুইটি শার্ট-পেন্ট পরেননি। আফরোজা বানুকে একটা ভালো শাড়িও পরতে দেননি। আজ সেই মেয়ে মা-বাবাকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। বিয়ের পর থেকে আফরোজা বানুকে মেয়েটি কাজের মহিলার মতো ব্যবহার করছে।
মতিন সাহেব মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। যা পেয়েছেন মেয়ের পেছনে বিলিয়ে দিয়েছেন। সবটুকু খরচ না করতে আফরোজা বানু মতিনকে অনেকবার বুঝালেও কাজ হয় নাই। ওল্টো বুঝেছেন। এমন কি আফরোজা বানুকে মতিন সাহেব মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, নিজের পেটের মেয়ে নয় বলে তোর হিংসা হয়।
সেই রাতে আফরোজা বানু মতিনকে কেঁদে কেঁদে বলেছেন। আজকে আমাকে তুমি যে আঘাত দিলে। একদিন তুমি এই মেয়ের কাছ থেকে একই আঘাত পেয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। আল্লাহতায়ালাকে আমি এই বিচার দিলাম। আর কোন সময় আমার মুখ থেকে তোমার সন্তানের জন্য কিসে ভালো, কিসে মন্দ সেকথা কোনদিন মুখ থেকে বের হবে না।
মতিন সাহেবের এটি দ্বিতীয় সংসার। কপালে ছিল নিজের কাঁধে স্ত্রী-সন্তানের লাশ নেওয়ার।
মতিন সাহেব সকালে স্কুটারের পেছনে ছেলেকে বসিয়ে স্কুলে নিচ্ছিলেন। ছেলে তখন ঝিমুচ্ছে। কখন যে স্কুটারের সিট থেকে নিচে পড়ে গেল, মতিন সাহেব টের পাননি। স্ত্রী সুপ্তি ছেলের লাশ দেখে ও বাবা বলে একটা চিৎকার করে উঠলো। মেডিকেলে আর নিতে হয়নি। সেখানেই সবশেষ।
মিষ্টি তখন তিন মাসের। মতিন সাহেব মিষ্টিকে বাঁচাতে আরেকটি বিয়ে করেন। প্রথমদিন থেকেই আফরাজা বানু মিষ্টিকে খুব ভালোবাসতেন। নিজের আর কোন সন্তান নেবার চিন্তা মাথায়ও আনেনি আফরোজা।
আজকে সেই মেয়ে মার সাথে বুয়ার মতো ব্যবহার করছে। শুক্রবার সকাল হতে না হতেই আফরোজা বানুকে মেয়ের ফোন।
মা, তোমার হাতের কাচ্চিবিরানি আর রুইমাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্টের তরকারি তোমার জামাইর বেশ পছন্দ। তুমি কি আসবে?
তোর বাবা উঠুক। তারপর আসি।
ঠিক আছে। বাবাকে নিয়ে এসো। বাজারে যেতে হবে।
আফরোজা বানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আজকে নিজের মেয়ে হলে কষে গালে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে পারতাম।মেয়ের জামাই বিরানি খাবেন। তাতে আফরোজার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আফরোজা বানুর মেয়ের বাসায় যেতে বিবেকে বাধে। মেয়ের জামাই কখনো সালাম করা দূরে থাক, ভালো করে কথাও বলে না।
মতিন সবকিছু বুঝতে পেরে মুখ বন্ধ করে আছেন।
নিজের সহায়-সম্পদ বলতে তেমন কিছু নেই। মেয়ের ইচ্ছে বর্তমানে যে টাকা আছে, সে টাকাও যেন বাবা বেঁচে থাকতে ওর নামে লিখে দেয়। মেয়ে বুঝতে চায় না মেয়েকে ডাক্তারি পড়িয়ে বিয়ে দিতেই সর্বস্বান্ত তিনি। মাসের শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে যা পান, ঘরভাড়া আর দুজনের ঔষধে সব চলে যায়।
কড়া রোদে মতিন সাহেব মেয়ের জন্য গরুর মাংস আনতে যান। মেয়ে টাকা দিয়েছে বাসভাড়াসহ হিসেব করেই। কষ্ট করে মাংস এনে দিয়ে আফরোজা বানুকে মতিন মুখ ফুটে বললেন, আজ মেয়েকে শেষ রান্না করে দিয়ে এসো। আফরোজা বানু ও মতিনের কথামতো রান্না করে মেয়েকে বলেন, মিষ্টি আমি যাচ্ছি তোর বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
মেয়ে মুখের ওপর বললো, আরেকটু বসো না মা। আমি একা-একা সবাইকে সামাল দিতে পারবো না। আর তুমি যাবার সময় বাবার জন্য কিছু নেবে না?
না মা, তোর বাবার এখন মাংস খাওয়া উচিত হবে না। এখান থেকে যাবার সময় বলেছেন, উনার নাকি খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
আফরোজা বানু বাসায় এসে দেখেন মতিন ঘামছেন । বুকের ভেতর প্রচ- ব্যথায় চিৎকার করছেন। আফরোজা বানু কেঁদে উঠে বললো।
: মেয়েকে একবার ফোন করে জানাই ।
মতিন সাহেব চোখের জল ছেড়ে বললো, ডেকে কি হবে আফরোজা। আমি তো তোমাকে সুখী করতে পারিনি। আমাকে বদদোয়া দিও না। মেয়েটাকেও মাফ করে দিয়ো। এই জগত-সংসারে তুমি যতক্ষণ গায়ে খাটতে পারবে, তোমার কদর ততক্ষণই থাকবে। আমি না থাকলে মেয়ের বাসায় যেও না।
আফরোজা মতিনকে শক্ত করে ধরে গাড়িতে তুলেন। আগ্রাবাদ শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় মতিন সাহেব দুটো হেঁচকি তুলেন। চোখের জল ছেড়ে চোখ বুজলেন। চিকিৎসক আফরোজা বানুকে বললেন, উনাকে কষ্ট করে গাড়ি থেকে নামানোর প্রয়োজন নেই। বাড়িতে নিয়ে যান। আফরোজা বানু তাই করলেন।
স্বামীর কথা রাখতে নিজের মেয়েকে আর খবর দেননি।
স্বামীকে নিজের বাবার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন আফরোজা বানু।