আলী প্রয়াস »
সকালবেলা, শহরের এক প্রান্তে জোরালো বাতাস বইছিল। শূন্য আকাশে কিছুটা মেঘের ভিড়, কিছুটা ধোঁয়া, কিছুটা বিশ্রাম। শহরটা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, সময়ের মতো। একটি আধুনিক ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল রাহা। সে জানত না কীভাবে আজকে তার কিছু একটা পরিবর্তন হওয়া দরকার। সময়টা ছিল অদ্ভুত, আর তার চারপাশের শব্দগুলো ক্রমাগতভাবে যেন আরও বেশি অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
রাহার মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটা তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। শহরের সকলের মতো, সে নিজেও এক ধরনের অন্ধকারের মধ্যে চলে গেছে। সবার সামনে হাসছে, কিš‘ গভীর ভিতরে তার হৃদয়ে একটা শূন্যতা। আজকের সকাল তার কাছে এক ধরনের সংকেত, যেন সবকিছু বদলে যেতে চলেছে।
তার চোখে একটানা ঝলকানো কিছু ধরা পড়ল। একজন পুরনো পরিচিত, সাব্বির, যে বছর খানেক আগে তার সাথে বন্ধুত্ব রেখেছিল, আজ তাকে আবার দেখতে পেল। সাব্বির দাঁড়িয়ে ছিল এক পাশে, চোখে অস্বস্তি। তার পা ছিল এক অদৃশ্য ভারে পিষ্ট। রাহা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল তাকে ঠিক বুঝতে পারছে না।
সাব্বির এগিয়ে এলো এবং বলল, ‘আমরা কি কখনও একে অপরকে সত্যিই জানব?’
রাহার মুখে কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু মনে হচ্ছিল, যে প্রশ্নটা সাব্বির করেছিল, তা তারও ভেতরে বারবার আলোড়ন নিয়ে আসছে। তারা একসাথে অনেক পুরনো স্মৃতি শেয়ার করেছিল, কিš‘ এখন কেন যেন সেসব কিছুই অদৃশ্য হয়ে গেছে।
‘তুমি জানো, সাব্বির’, রাহা বলে, ‘আমরা কখনো পুরোপুরি একে অপরকে বুঝতে পারব না। আমাদের মনে অনেক অন্ধকার রয়েছে, যার মাঝে আমরা আছি।’
সাব্বির নীরব হয়ে গেল। সে জানত, রাহার কথাগুলো খুবই সত্যি। তারা যেন একে অপরকে অজান্তেই ভুল বুঝেছিল, এবং তাতে তাদের সম্পর্কটি এক ধরনের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
রাহা সেদিকে তাকিয়ে থাকল, কিছু একটা অনুভব করছিল। সে অনুভব করল, পৃথিবী সত্যিই সবার জন্য এক নয়। সকলের ভিতরে আলাদা আলাদা সংগ্রাম চলে, এবং সেই সংগ্রাম কখনো থেমে না। কিš‘ তার মধ্যে যা কিছু অদৃশ্য ছিল, তা তাকে নিয়ে যাচ্ছিল এক নতুন পথে।
পরদিন সকালে, রাহা সিদ্ধান্ত নিলো, সে শহর ছেড়ে চলে যাবে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, এক অদ্ভুত ভরসা তাকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল সে, আর মনে হচ্ছিল যেন শহর তার পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে। কিš‘ এমন কিছু ছিল, যা তাকে বারবার টেনে নিয়ে চলছিল। সে জানত না সে কোথায় যাচ্ছে, কিš‘ তার পা চলছিল, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে পথ দেখাচ্ছিল।
রাস্তার শেষ প্রান্তে গিয়ে, এক বিশাল এবং পুরনো বাড়ির সামনে এসে থামল রাহা। বাড়িটি অনেক দিন ধরে অযত্নে পড়ে ছিল। সেখানে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সে কিছুটা দ্বিধায় ছিল। তবে শেষমেশ তার পা যেন তার মনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। বাড়ির দরজা খোলার পর, ভেতরে প্রবেশ করতেই রাহা যেন এক রহস্যের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সে জানত না এই বাড়িতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তবে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
বাড়ির ভেতরে কিছুটা অন্ধকার, কিছুটা উজ্জ্বলতা ছিল, এবং রাহা অনুভব করল, সেই উজ্জ্বলতার ভেতরেও কিছু অজানা ছিল। যেন অন্ধকারের মধ্যে আলো ফোটানোর চেষ্টা চলছে। সে পেছনে তাকালো, সাব্বিরের মুখ মনে পড়ল। তাদের সম্পর্কের মধ্যে যে অন্ধকার, তা কি একদিন কাটবে? এক মুহূর্তে তাকে মনে হলো, তার নিজস্ব সংগ্রাম এবং অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে।
একদিন, রাহা আবার সেই রাস্তা ধরে হাঁটছিল। আজ সে নিজেকে আর একা মনে করছিল না। রাস্তা আর বাড়ির পেছনে ফিরতে গিয়ে, মনে হচ্ছিল যেন সে জীবনকে নতুন করে দেখতে শিখেছে। তার চোখে অন্ধকারের ভেতরে আলো দেখা যাচ্ছিল।