অরূপ পালিত »
আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে তুমি। কিন্তু শত চেষ্টা করলেও ভুলে থাকতে পারবে কী?
সুধার চুলের ডগা দিয়ে বিন্দু-বিন্দু জলগুলো দেখতে মনে হচ্ছে সকালের সবুজ ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা মুক্তার দানার মতো। সন্ধ্যানীল আকাশের অপরূপ সৌন্দর্যে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে সুধার সৌন্দর্যকে মিলিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সুধা ইচ্ছে করে কোমড়ছাপানো ভিজে চুলগুলো ঝেড়ে নিচ্ছে না। তোয়ালে দিয়ে চুলের আগায় টাস-টাস করে আওয়াজ করা সাঁকোর একদম পছন্দ নয়। সাঁকো ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে। খালি গায়ে থাকলে সাঁকোর প্রতি কিসের যেন আকর্ষণ অনুভব হয়। চলাফেরার সৌন্দর্য্যতায় আর শৌখিনতা সাঁকো নিজেকে মনে-মনে অ্যাডোনিস মনে করেন। মনে করার কারণও আছে। গ্রিক উপকথার সুদর্শন সুপুরুষ অ্যাডোনিস এই সাঁকোকে দেখলে অন্তর্দাহে পুড়ে মরতেন। আর ওনার প্রেমিকা সৌন্দর্যের গ্রিক দেবী আফ্রোদিতিও সাঁকোকে দেখলে বিহ¦লা হয়ে যেতেন।
সুধাও একেবারে কম নয়। নিজেকে অনিন্দিত করতে কয়েকবার কসমেটিক সার্জারি করিয়েছেন। তাঁর আসল রূপ কেউ দেখেছেন বলে জানা নেই। অন্ধকার জগতের অনেকেই ভয় করেন এই সুধার রূপ যৌবনকে। অদ্ভুত রহস্যময় এই শিকারি নারী জীবন। ওর গালে টোল পড়া প্রানবন্ত হাসিটা যেকোনো পুরুষের হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যাবে। সাঁকোর মোহনীয় সৌন্দর্য্য আর মিষ্টি কথার ঝুড়িতে সুধার প্রাণহীন দেহে সজীবতা ফিরিয়ে আনে। অবসাদ কাটিয়ে নৈঃস্বর্গিক কৌমুদী রাতে সাঁকো ও সুধা নির্জনে তৈরি হচ্ছেন একান্ত সময় কাটানোর জন্য। দিগন্তজোড়া সবুজ অরণ্যে এই দু’জনে একসাথে হওয়ার সময়টাতে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আরো একজন দুর্নীতিবাজ দুশ্চরিত্র আমলা।
সাঁকো ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সুধার কানে-কানে ফিসফিস করে বলল, ‘এমন রূপে তোমাকেই চেয়েছিলাম নীল অপরাজিতা।’
সুধা বলে উঠলো, ‘এই নামে কেন ডাকো তুমি? যার শিকড় হতে ফুল পর্যন্ত অন্যের কাঁধে ভর করে বাঁচতে হয়।’
‘তুমি আমার নীল প্রজাপতি। একমাত্র তুমি পারো অস্ফুটো কলির ফুল ফোটাতে।’
‘ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই সুহৃদ; কিছু মুহূর্ত সময়ের জন্য আজকের রাতটা তোমার-আমার।’
তখনি চন্দ্রের মিষ্টি হাসিতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কৃষ্ণকালো জলধর। সাঁকো মিষ্টি কন্ঠে সুধার কানে ফিসফিস করে বললো,
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;পৃথিবী সব রং নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
সুধা কাটখোট্টা। সাঁকোর এমন কবিত্বের প্রত্যুত্তরে সময় বেশি নেয়নি।
‘বনলতা কবিতায় বা বনলতার সৌন্দর্য কবি কোন কিছু উপভোগ করতে পারেনি তোমাদের কারণে। যতটা তোমাদের মতো লেখকের হৃদয়ের প্রশান্তির ছোঁয়া লেগেছে। বনলতাকে আর কত নিচে নামাবে? কেউ বলছে বনলতা একজন সুন্দরী পরিচারিকা। আর কেউ একজন বলেছিলেন ভুবন সেনের সুন্দরী বিধবা বোন, আজও মূল রহস্য উন্মোচন কেউ কি করতে পেরেছে? প্রিয়তমার জন্য ’দাশ বাবুর’ বাস্তবিক লোকমুখে গর্বিত ভালোবাসা। ’দাশ বাবু’ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তোমাদেরকে পয়জন দিয়ে মেরে টাটকা রোদে শুকিয়ে পিস-পিস করে কেটে হাড় দিয়ে বনলতার গলার হার করে দিতেন।’
উত্তেজিত সুধাকে সাঁকো বুকে টেনে নেয়। নিস্তেজ হয়ে আসে বিচলিত মন।
‘কবি বনলতার মধ্যে বিশ্বের বেবাক সর্বশ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত অত্যাশ্চর্য বস্তু কবির পক্ষে এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রিয়তমার হেলেনিক সৌন্দর্য বর্ণনা করার জন্য অপর্যাপ্ত। বনলতা সেই নীহারিকা যে কবিকে কিছুক্ষণের জন্য সংসারের যন্ত্রণা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সেটাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার নাম ভালোবাসা। জানো! সে নারী শুধু কবিকেই নয়, পাঠককেও বিভ্রান্ত করে-এতদিন কোথায় ছিলেন?’
‘অসম্ভাবিত তোমার আমার মিল। অথচ দেখ! আমাদের সম্পর্কের কোন নাম নেই। হয়তো এই সম্পৃক্তি বিধাতার সৃষ্টি।
বয়সের প্রতিপ্রবাহে নোঙর চেপে লাভ কী? নবমুকুলিত প্রজাপতির মতো ডানা মেলে পারবে না উড়তে। মধুর সাধ নেওয়ার তোমার সময়টা কই? এখন আমার কাছে হয়তো কিছুক্ষণ পর আবার উড়াল দেবে কোন সাদা চামড়ার পরাগায়নে।’
এমন বেরসিক বৃষ্টি আর আসার সময় পায়নি। জন-মানব শূন্য এই অরণ্য সুন্দরীর নির্জনতা ভেঙে দিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। কিছুক্ষণ আগেও ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চন্দ্রের চকচকে আলো। অলস ডিঙ্গি প্রস্তুত করেছিল দু’জনে মিলে ভরা বর্ষায় ভাসতে ভাসতে ডিঙ্গি থেকে লাফিয়ে পড়বে নীল জলে। বৈরী আবহাওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে গতিহারা হয়ে গেছে ডিঙ্গিটা।
এই সাঁকো আর সুধা এক সাথে হওয়ার গল্পটা এতো সহজ নয়।