অনিশ্চয়তায় রোগীরা

চমেক হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস

নিজস্ব প্রতিবেদক »

১৫ বছর আগে কিডনি রোগে আক্রান্ত হন ফটিকছড়ির অনিল মন্ডল (ছন্দনাম)। আক্রান্ত হওয়ার সাত বছর পর ডায়ালাইসিস নিয়ে চলছে তার জীবন। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রথম দিকে আয়-রোজগার ভালো থাকায় বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে পারতেন। এখন বয়সের কারণে বেড়েছে রোগ, কমেছে আয়। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়াটা তার কাছে একেবারেই অসম্ভব। তার কাছে ভরসার জায়গা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা। অনিল মন্ডল ছাড়াও অনেকে এ সেবা নিতে এখানে আসেন।

আড়াই বছর ধরে সুলভমূল্যে উন্নতমানের এ সেবা নিচ্ছেন অনিল। কিন্ত সেটিও এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আর বন্ধ হয়ে গেলে এখানেই চিকিৎসা শেষ, পরপারে যাওয়ার দিনক্ষণ গণনা শুরু বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী।

তিনি আরও জানান, চমেকে ৫১০ টাকা করে সপ্তাহে দুটো ডায়ালাইসিস নিতে পারেন তার স্বামী। যেটি বেসরকারি হাসপাতালে করালে প্রতিটির খরচ পড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। তাই সরকারের কাছে আকুল আবেদন আমাদের মতো অসহায় মানুষগুলোর জন্য সেবাটি যেন চালু রাখে। তা না হলে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে অসংখ্য কিডনি রোগী।

একই কথা জানান সাজেদা বেগম (৪৬)। তিনি রাউজান থেকে সপ্তাহে তিনবার চমেকে হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করান। তিনি বলেন, ‘কম টাকায় সেবা নেওয়া যায় শুনে দুই বছর ধরে এখানে সেবা নিচ্ছি। এখন শুনলাম সেবাটি বন্ধের পথে।

যদি বন্ধ হয়ে যায়, আমরা বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবো না। এটাই আশ্রয়স্থল, এটাই আমাদের শেষ ঠিকানা। এটা ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার রাস্তা নেই। কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলেন তিনি।

অন্যদিকে করিম ইসলাম (ছন্দনাম)। নগরীর আগ্রবাদ থেকে মাকে নিয়ে সপ্তাহে তিনবার হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে আসেন। তিনি বলেন, ‘যাদের পরিবারে কিডনি রোগী আছে, তারাই জানে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনীয়তা। চমেকের এ সেবাটি কতটা উপকারে আসছে শুধু তারাই জানে। এখানে প্রতিদিন ১০০ জনের বেশি মানুষ সেবা নেয়। এতগুলো অসহায় মানুষ যাবে কোথায়। যাওয়ার তো পথ নেই’। দরিদ্র রোগীদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দেয়ার দাবি জানান তিনি।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) প্রতিদিন বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেডের সহযোগিতায় চারভাগে ৩০ জন করে প্রতিদিন ১২০ জনের ডায়ালাইসিস করানো হয়। বর্তমানে ৩১টি মেশিন রয়েছে। চট্টগ্রাম নগর, উপজেলা এবং বাইরের জেলা থেকে ও সেবা নিতে ভিড় দেখা যায়। প্রতিটি ডায়ালাইসিসে ৫১০ টাকা চার্জ নেওয়া হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ৪ মার্চ ঢাকার জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা চালু করে ভারতীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেড। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ১৮ কোটি টাকা বকেয়া সরকার পরিশোধ না করায় সেবা বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। পরে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এরপর একমাসেও অর্থ পরিশোধ না করায় ২ ফেব্রুয়ারি আট ঘণ্টা সেবা বন্ধ রাখে। ওইদিন দুই পক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকেল চারটা থেকে ফের সেবা চালু করা হয়। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর চমেক পরিচালক বরাবর চিঠিতে বকেয়া ২২ কোটি টাকা পরিশোধ না করলে সেবা বন্ধের আল্টিমেটাম দেয় প্রতিষ্ঠানটি। পরে তৎক্ষণাৎ চিঠিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে চমেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি আমরা একটি পত্রিকায় বলেছি। ওটাই শেষ আপডেট। ওই পত্রিকায় বলা হয় ‘বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সেবাটি যাতে বন্ধ না হয়। তা না হলে দুর্ভোগে পড়বে রোগীরা। রোববার (১৬ অক্টোবর) স্যান্ডরের এমডির সঙ্গে কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মহোদয়। যতটুকু জেনেছি স্যান্ডরও সন্তোষ প্রকাশ করেছে। ’

তিনি আরও যোগ করে বলেন, আজও (১৭ অক্টোবর) মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলেছি, তারা খুব দ্রুত বিষয়টি নিয়ে কাজ চালাচ্ছে।

বকেয়া ঠিক কখন পরিশোধ করা হবে? আগের মতো বারবার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি সরকারের একটি বিষয়। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে পেমেন্টে যাবে। নির্দিষ্ট করে তো বলা যায় না। তবে যেহেতু গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে, আশা করা যায় পেমেন্টে দ্রুত আসবে। আগের মতো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না মনে হচ্ছে’।

সেবা সেন্টারে কাঁচামালের সংকট, যা আছে তা দিয়ে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত যাবে। এখন স্যান্ডর কাঁচামাল দিতে রাজি হয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কাঁচামাল দিতে সম্মত হয়েছেন তারা। আশা করছি শীঘ্রই পৌঁছাবে। মোট কথা সেবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখছি না’।