সুপ্রভাত ডেস্ক »
কোনো পণ্যের মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ‘ডেলিভারি কোম্পানির’ কাছে তা হস্তান্তর করে ক্রেতাকে জানিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রেখে অনলাইনে বেচাকেনার একটি নির্দেশিকা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ডিজিটাল বেচাকেনায় ‘স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা’ আনতে ৬৯টি ধারার ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা’ জারি করা হয়।
মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে গেজেট আকারে প্রকাশিত নির্দেশিকাটি পড়ে শোনান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “ই-কমার্স ব্যবসার যাতে সুষ্ঠু বিকাশ হয় এবং তাদের প্রবৃদ্ধি বজায় থাকে, একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বিরাজ করে, সেজন্য সব পক্ষের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এই নির্দেশিকা করা হয়েছে।”
নির্দেশিকায় বলা হয়, বিক্রির জন্য প্রদর্শিত পণ্যের পুরো দাম পরিশোধ করলে সেই পণ্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ‘ডেলিভারিম্যান’ কিংবা ‘কোম্পানির’ কাছে দিতে হবে। সেই তথ্য ক্রেতাকে জানাতে হবে এবং পণ্যের অবস্থান ‘ট্র্যাক’ করতে হবে।
ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে থাকলে সর্বোচ্চ ৫ দিন এবং ভিন্ন শহরে থাকলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য হস্তান্তর করা নিশ্চিত করতে হবে।
নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, ই-কমার্স কোম্পানিগুলো ১০ শতাংশের বেশি অগ্রিম টাকা নিতে পারবে না। কোনো ‘ক্যাশব্যাক’ বা ‘ডিসকাউন্টের’ ঘোষণা দিলে তা নিজেদের ওয়ালেটে না রেখে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
আর প্রতারিত বা সংক্ষুব্ধ হলে দেশের প্রচলিত বিচারালয়ের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন ক্রেতারা।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, মহামারীতে ডিজিটাল বেচাকেনা বেশ বিস্তার লাভ করছে। অনেকে এই সুযোগে অনেক বেশি ডিসকাউন্ট দিচ্ছেন। অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, এর ফলে এই ব্যবসায় বড় ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে।
“কিভাবে ব্যবসা পরিচালিত হবে এনিয়ে এখানে একটা শূন্যতা ছিল। পণ্য কিভাবে পৌঁছাবে, পেমেন্ট কিভাবে হবে এসব নিয়ে অভিযোগ আসছিল। এজন্য ভোক্তাবান্ধব এবং ব্যবসাবান্ধব ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা করেছি আমরা।”
তিনি জানান, কোনো পক্ষ যাতে প্রতারিত না হয় সেজন্য জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা-২০২০ অনুযায়ী এই নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। এটি প্রথম ধাপ, প্রয়োজনে এখানে আরও সংযোজন বিয়োজন করা যাবে।
নির্দেশিকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা
♦ পণ্য বিপণনের শর্তগুলো পণ্যের পাশে বাংলা ভাষায় স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে। বাংলার পাশাপাশি অন্য ভাষায়ও লেখা যাবে। প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো শর্ত জুড়ে দেওয়া যাবে না।
♦ ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপণন করা পণ্যের সব বিবরণ ও শর্ত উল্লেখ থাকতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে ‘এমএলএম’ পরিচালনা করা যাবে না। ‘জুয়া’ বা ‘অনলাইন বেটিংয়ের’ আয়োজন করা যাবে না।
♦ ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে। দাহ্য পদার্থ বিক্রির ক্ষেত্রে লাগবে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স। বিক্রেতার ওয়েবসাইটে বিশেষ সফটওয়্যার বা কুকিজ থাকলে আগেই ক্রেতাকে জানাতে হবে।
♦ গ্রাহকের কোনো ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতে হলে সেজন্য আগেই তার সম্মতি নিতে হবে। ‘লটারি’ বা ‘র্যাফেল ড্র’ করতে হলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে।
♦ সব ধরনের ডিজিটাল ওয়ালেট, গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বা অন্য কোনো মাধ্যম যা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে, সেসব বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো ধরনের অর্থ ব্যবসা করা যাবে না। ক্রেতাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো পণ্য বা সেবা কিনতে বাধ্য করা যাবে না।
♦ ডিজিটাল ব্যবসা পরিচালনাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন, টিআইএন, ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা পারসোনাল রিটেইল অ্যাকাউন্টের কোনো একটি গ্রহণ করতে হবে এবং তা ওয়েবসাইট বা সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রদর্শন করতে হবে।
♦ লেনদেনের সব তথ্য অন্তত ছয় বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। অন্য কোনো চুক্তি না থাকলে সংশ্লিষ্ট মার্কেট প্লেসে পণ্য বিক্রয় করার পর দাম বুঝে পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে বিক্রেতাকে তা দিয়ে দিতে হবে।
♦ মার্কেট প্লেসকে বিক্রেতাদের নাম, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, ঠিকানাসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
♦ দেশের ভেতরে অবস্থান করছে এমন পণ্যের জন্যই কেবল অগ্রিম মূল্য নেওয়া যাবে। মূল্য গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হস্তান্তর করা না গেলে ১০ শতাংশের বেশি মূল্য নেওয়া যাবে না। এর বেশি মূল্য নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘এসক্রো সার্ভিসের’ মাধ্যমে নিতে হবে।
♦ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভোক্তার অভিযোগের সমাধান করতে একজন ‘কম্প্লায়েন্স অফিসার’ নিয়োগ দিতে হবে। তিনি ভোক্তার অভিযোগ নিয়ে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করবেন। অভিযোগপ্রাপ্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা সমাধান করে ফোন, ইমেইল অথবা এসএমএসের মাধ্যমে জানাতে হবে।
♦ ক্রয়াদেশ গ্রহণ করার পর পণ্য বা সেবা দিতে না পারলে অর্ডারের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা ক্রেতাকে জানাতে হবে। আর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে টাকা ফেরত দিতে হবে।
♦ প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংক্ষুব্ধ গ্রাহক ভোক্তা অধিকার কিংবা আদালতে যেতে পারবেন।
♦ ডেবিড, ক্রেডিট, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যংকিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলে এবং বিক্রেতা নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে ক্রেতাকে সমপরিমাণ অর্থ ফেরত দিতে হবে। যে মাধ্যমে টাকা এসেছে ফেরত যাবে একই মাধ্যমে এবং কোনো চার্জ প্রযোজ্য হলে তা মার্কেট প্লেস বা বিক্রেতা বহন করবে। তবে ক্রেতা যথাসময়ে পণ্য গ্রহণে ব্যর্থ হলে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
♦ যে কোনো মূল্য হ্রাসের ঘোষণা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করতে হবে। ‘অফারমূল্য’ পরিশোধের পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাশব্যাক কার্যকর করতে হবে। বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার পর ‘ক্যাশব্যাক অফার’ বা ‘মূল্যছাড়ের’ ঘোষিত অর্থ কোনো ই কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওয়ালেটে জমা রাখা যাবে না।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই নীতিমালা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় ব্যবসায়ী নেতারা তাকে ধন্যবাদ জানান।
বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, “ডিজিটাল কমার্সের জন্য এটা একটা মাইলস্টোন। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করে কিভাবে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করা যায় এখানে সেগুলোই বলা আছে।
“গত ১৫ মাসের মহামারীর মধ্যে অনেক বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। যখন কোনো ইন্ডাস্ট্রি শুরু হয় তখন এমন একটা পরিস্থিতি হয়। এখন নির্দেশিকার মাধ্যমে এই ই কমার্স একটি মহীরুহে পরিণত হবে।”
তবে এই নির্দেশিকা বাস্তবায়নে সব পক্ষকে সংযুক্ত করে কেউ যাতে নির্দেশিকা অমান্য করতে না পারে সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সেলকে অনুরোধ করেন তিনি।
ই কমার্সের বার্ষিক আকার এখন এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি জানিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, “আগামী ২ বছরের মধ্যে এটা তিন বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে।”
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা, প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপার্স মফিজুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
ই ক্যাবের সভাপতি শমী কায়সার বলেন, “জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এসওপি করা হয়েছে। এই জায়গাটি নিয়ে গত এক বছরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করাই ছিল এসওপির অগ্রাধিকার।”
সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে এই নির্দেশিকা ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ডিজিটাল কমার্সে ৯৭ শতাংশই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। পুরো মার্কেটে যেন একটা সমতা থাকে সেজন্য সবার সুরক্ষার কথা এখানে বিবেচনা করা হয়েছে। মার্চেন্ট-সেলার সম্পর্ক, পেমেন্ট সিস্টেম, পণ্যের ডেলিভারি নিয়ে এখানে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে।
“অস্বাভাবিক কোনো ধরনের অফার এখানে দেওয়া যাবে না। সেই বিষয়টি এখন থেকে পরিষ্কার হয়েছে। ভোক্তারাও অনেক সচেতন। পণ্য কেনার সময় ওয়েবসাইটে দেওয়া শর্ত থাকবে, সেগুলো ভালোভাবে দেখে নিতে হবে,” বলেন তিনি।