অচিন্ত্য আইচ : একাকিত্বের পূর্ণাঙ্গ মোহর

শোয়েব নাঈম »

অচিন্ত্য দা‘র একাকী জীবনের বিপ্রতীপ কোণে ছিল অনন্ত শিল্পবোধ। তাঁকে ফুলকিতে পেয়েছিলাম অভাবিত প্রাপ্তির এক মহিমার মতন, যিনি চারুকলা বিষয়ক আমার অনুভূতির উপর শিল্পের এক ঐশ্বর্যময় স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সংবেদনশীলতার বিনীত মুখটি দিয়ে চারুকলার থুতনি ওপরে ধরে তুলেছিলেন। যিনি সম্পর্কের অধিকারে বিম্বিত করে গেছেন হৃদয়ের প্রশস্ততাকে। যেভাবে গতি দিলেন আমাদের যৌথ সম্পর্কের মাত্রাতে, সেখানে আমার ভিতর আগুন ধরিয়ে দিলেন শ্রদ্ধায় তাঁকে ভালোবাসতে। ‘অচিন্ত্য দা’- এই সম্বোধনে তিনি তখন ফুলকির সবার মুখে মুখে। এই ডাকের নেপথ্যে ছিল না কখনো ছন্দের চারমাত্রার প্রভাব, অথবা অচিন্ত্য দা তিন-এক অক্ষরে ভাগ হয়ে যাওয়া মাত্রায় শ্রবণজনিত কোনো সুবিধার কারণেই প্রিয় ছিলেন না। ওই চারমাত্রার কারণেই যাদের নাম তিন অক্ষরের, তাদের নামের পরে ‘দা’ যোগ হলে মানুষের কান অনেক স্বস্তি পায় এমন কারণে অচিন্ত্য দা কখনোই সবার প্রিয় হয়ে ওঠেননি। তখন ফুলকি ছিল শিশুতোষ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্যের ধ্বনিময় এক প্রাঙ্গণ, আর ছিল আড্ডা আধিক্যের মহাপ্রকৃতি। এই প্রাঙ্গণের প্রেরণা এবং এর পারিপার্শ্বিকতা অনেককেই সৃজনশীলতায় বিস্মিতভাবে গড়ে তুলেছিল। এখানে এসে আবিষ্কার করলাম আমার অজ্ঞতার গভীরতা। অন্তহীন সম্মোহনের মতো এই ফুলকি প্রাঙ্গণ তখন আমাকে ধীরে-ধীরে তুলিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। যখনই ফুলকিতে আসতাম, সবসময় অচিন্ত্য দাকে দেখতাম অনন্ত গভীরতায় সৃজনভারে তিনি চিন্তাগ্রস্ত এবং বিচিত্রবিন্যাস মনোভারে ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত। তাঁর চোখের দিকে তাকালেই বুঝতাম অচিন্ত্য দার প্রায় প্রতিটি সকালই আসলে ক্লান্ত রাত্তির-ই উচ্ছিষ্ট ফলাফল এবং আগের রাত্তির প্রসারিত বেদনাবোধ। ব্যথা নিয়ে জেগে থাকা রাত উপশম দেবে বলে, মনে হয় তাঁর ভোর ফুটতো উন্মীলিত চোখ ছিঁড়ে। যতবার এখানে আসতাম, দেখা হলেই ফুলকিতে তাঁর হাসির সম্ভাষণে আমাকে সম্বোধন করতেন। কিন্তু তাঁর এমন হাসিমুখ ছিল আত্মরক্ষাহীন জীবনের পলাতক হাসি। এমন হাসিমুখ দিয়েই আমার উপস্থিতিকে এক সংবেদে পরিচ্ছিন্ন করতেন। প্রতিপক্ষহীন মন্থরতায় ৭১ বছর আয়ুর সমান তাঁর এই জীবন ছিল আয়ুর অস্পষ্ট কালহীনতার বিস্তার। যে অস্পষ্টতার কালহীনতায় ভেঙেছে আর গড়েছে রক্তের আর্তনাদ। আয়ুর সেই বছরগুলি তো জীবনসকালেই পান করে বসেছিল শিল্পবোধের হলুদ পাতার হেমলক, যে শিল্পবোধ এখন উজ্জ্বল করে রেখেছে তাঁর মৃত্যুর এপিটাফ। আত্মবিস্তারের রহস্যে মোড়ানো ছিল তাঁর বাস্তব, যিনি জানতেন উদ্ভাসনের ভিন্নতর দ্যোতনা এবং উপলব্ধির নির্জন সংকেত।
অচিন্তা আইচের দিকচিহ্নহীন জীবনের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে বলতে হয়, অচিন্ত্য আইচ সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানতেন যে, অচিন্ত্য দা ছিলেন ক্রিকেটের তথ্য-মাতাল এক এলাহি ভক্ত। তাঁর প্রিয় ছিল ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ, যা তিনি রেডিওতে বিরতিহীনভাবে রানিং কমেন্ট্রিতে শুনতেন। প্রতি ওভারের বল-টু-বল উত্তেজনার ধারাবিবরণী টান টান উপভোগ করতেন। আমরা অনেকই সেই কমেন্ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর মানবিক সারল্যে ম্যাচ অনুভূতির প্রতিক্রিয়া শুনতাম, ফুলকিতে। রেডিওতে রানিং কমেন্ট্রি শুনতে-শুনতে ওনার বোধে অনেক শান্তি আসতো, তবে সেই বোধ কখনো জীবনানন্দীয় বোধ ছিল না। আত্মপ্রতিরূপের ন্যায় তাঁর ক্রিকেটবিলাসী এমন কাতরতা অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
নৈঃশব্দ্য-দূরত্বশাসিত একজন শিল্পী যেভাবে তাঁর কিংবদন্তিকে উদযাপন করে, অচিন্ত্য দা তেমনি করে তাঁর কিংবদন্তি সৃজন করতেন। কখনো কখনো সমবেত মৌনতা দিয়ে তিনি জাপানি প্রথায় ফুল দিয়ে ইকেবানা শিল্পের সংমিশ্রণ ঘটাতেন। ফুলের অন্তহীন ভাষ্যের মতন শিল্পের জিজ্ঞাসা করে তিনি ফুলকি আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে সাজিয়ে দিতেন। ফলত আমন্ত্রিত অতিথিদের অনুভবে এই শিল্প তখন বোধের অবিরাম মুহূর্ত গড়ে তুলতো। কখনো কখনো সৌন্দর্য-চেতনা, কখনো বা শৈলীর চমৎকারিত্ব, কখনো বা উপলব্ধির শিল্পরূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইকেবানা শিল্পের চর্চা করতেন। তিনি ফুলের এমন শিল্পবোধ দিয়ে ধারণাতীত শিল্পের অনন্ত প্রবাহকে প্রলুব্ধ করতেন। তিনি আত্মীকৃত করেছেন ফুলকি প্রাঙ্গণে নানা জাতের ফুলের বাগানের বিস্তার করে। বিভিন্ন ফুলের বাগানচর্চা ছিল তাঁর নিজেরই অপর আদল, যা তিনি নিয়মিত করতেন নিজেরই আত্মার বিক্ষিপ্ততা কুড়িয়ে এনে পূর্ণাঙ্গতা নিশ্চিত করতে। নিজেকে ফুলের মধ্যে গুজিয়ে দিয়ে সরাসরি নিজের বোধের সৌরভ ছড়াতেন।
উনি আমাকে সবসময় ‘নইম’ বলেই সম্বোধন করতেন। সেখানে বয়সের কোনও সীমারেখা ছিল না, সেখানে ছিল তাঁর মুক্তমনের চির তারুণ্যবোধ। ফুলকির দোচালা টিনের নিচে, শাদা খদ্দের পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামায় তিনি ক্লাসটেবিলের ওপর বসে থাকতেন। সামনে এসে দাঁড়ালেই ফ্যাসফেসে কন্ঠস্বরে বলতেন, ‘কেমন আছো নইম….. বোসো….’।
প্রায় সময়ে ঠোঁটের কোণে তর্জনী ঠেকিয়ে কথা বলতেন । প্রায় দেখতাম আয়ু থেকে তাঁর সময় বের করে নিয়মিত ‘দেশ’ পত্রিকা পড়তেন। ’দেশ’ নিয়মিত পাঠে ও উপভোগে অনেক বেশি প্রসারিত ছিলেন। সেই ‘দেশ’ থেকে সুনীলের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এবং সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’ ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়মিত পাঠ করতেন। এই ধারাবাহিক উপন্যাস দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টের হওয়া সত্ত্বেও, এই দুটির অব্যাহত পাঠের প্রতিক্রিয়ায় অচিন্ত্য আইচের চেতনের পরিমণ্ডলে তা সাহিত্যের একগুচ্ছ সংকেত হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি তাঁর অন্তর্গত প্রেরণায় সাহিত্যের অন্যান্য বই পাঠেও প্রলুব্ধ ছিলেন।
পোশাকের অনেক বিবর্তন দেখেছি, কিন্তু অচিন্ত্য দার গায়ে সবসময় থাকতো ঢিলেঢালা খদ্দর পাঞ্জাবি আর পাজামা। ফ্যাশনবোধের সঙ্গে শৈলীর পরাগায়নের কারুকার্যে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধান ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের স্মারকচিত্র। এই খাদিকে তিনি পোশাকের উদ্দিষ্ট শিল্পে রূপান্তরিত করে নিয়মিত তাঁর কিংবদন্তিকে উদযাপন করতেন। খদ্দরের অনভ্যস্ততার দূরত্বকে তিনি পুষিয়ে দিয়েছিলেন ফ্যাশনের নিপুণ অর্থময়তার বিনিময়ে। এমন অভ্যস্ততায় তিনি আজীবন খদ্দর পাঞ্জাবির পরিপূর্ণ নিটোল বলয় তৈরি করেছিলেন। এই শৃঙ্খলিত খাদির পোশাকই ছিল তাঁর ফ্যাশনসত্তার স্বাধীন সম্প্রসারণ। খদ্দর পাঞ্জাবি আর পাজামাকে নিছক পোশাক হিসাবে নয়, বরং তাঁর ফ্যাশনসত্তার স্বাধীন সম্প্রসারণ হিসেবে দেখলেই অচিন্ত্য আইচের সৃজনশীলতার পরিপূর্ণ আদলটি অনুধাবন করা যায়। এমন পোশাকের সারাৎসারে তিনি ছিলেন শৃঙ্খলমুক্ত কল্পনা ও অবচেতনের উৎসার। তাঁকে খাদি পোশাকের এমন পরিধানকে আমি নিখাদ নবরূপকারের যাপিত জীবনেরই উদ্ভাসন মনে করি। খদ্দরের পাঞ্জাবীতে আপনাকেই মানায় অচিন্ত্য দাকে আমার এই কথাটা কোনোদিন বলা হয়নি। স্বপ্ন সম্ভাবনার উচ্চাশী এই পৃথিবীতে অচিন্তা আইচ আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না।
ফুলকির শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম, চারুকলা বিষয়ক তাঁর অবসেশান, বিভিন্ন মেলায় কারুকার্যময় স্টল নির্মাণ, ফ্যাশনমুখী দেশীয় কাপড়ের বুটিক শিল্প এসব শাখায় ভাবুকতায় এবং সৃজনের মৌলিক দীপ্তিতে অচিন্ত্য আইচ আজীবন গুরুত্ববহ ছিলেন। শুধু ছিলেন না, তিনি শিল্পের আদর্শতম জায়গায় অবস্থান করছিলেন। মেলার স্টল স্থাপনায় তিনি ছিলেন কারুকার্যের জৌলুস। প্রচলপিষ্ট পৌনঃপুনিক কাজের ধারা এড়িয়ে তাঁর নতুন সংবেদনকে যথাযথভাবে প্রকাশের অনুকূল হয়ে উঠেছিলেন গত শতকের শেষ দশকে চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত ‘সি আই টি এফ’-এর শিল্পমেলায়। বিশাল টিম নিয়ে এই মেলাকে তাঁর সৃজনী ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য ও তীব্রতায় অনেক বেশি অর্থময় করে তুলেছিলেন। তাঁর টিমের আন্তরিক ইচ্ছা বিকাশের ভ্রুণে ‘সি আই টি এফ’-এর এই মেলা আন্তর্জাতিক বিন্যাস হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল অভীক ওসমান, খালিদ আহসান এবং অচিন্ত্য আইচ- এই তিনেরই সংক্রমণে, তাঁদের মিতাচারী স্বভাবে, মিতব্যয়িতার প্রস্বরে এবং মহাইচ্ছার প্রলুব্ধে।
এরকম একজন মানুষ যখন চলে যান অনন্তের পথে, তখন পিছনে রেখে যান তাঁর উজ্জ্বল দীর্ঘ ছায়া। যিনি মানুষেরই ভূমধ্য তিমিরে লুকোতে চেয়েছিলেন বলে আরও দীপ্যমান হয়ে উঠেছিলেন। উজ্জ্বলতায় প্রখর অচিন্ত্য দার সেই ছায়া এখনও মানুষের মধ্যে আলো দেয়, ভাষা দেয়, অধিকন্তু তাঁকে ফিরে পাবার স্বপ্ন দেয় ঘোর। কেননা তাঁর মৃত্যু জীবনকে সমাপ্তি টেনেছে মাত্র, অস্তিত্বকে অস্তিত্বহীন করতে পারেনি এখনও। তিনি অস্তিত্বের পাশেই অনস্তিত্ব এক দৃশ্যমান মানবিক স্বরূপ উন্মোচন রেখে গেছেন পৃথিবীতে। এমন অভিব্যক্তিতে অনুগত হয়ে এখন আমরা অনস্তিত্বের এক দৃশ্যমান মানবিক স্বরূপে তাঁর সাথে অন্তরঙ্গতা অনুভব করি। কিন্তু অচিন্ত্য আইচের নিঃসঙ্গতার সেই দিনগুলি নিয়ে আমাদের আর কোনোদিন জানা হবে না, তাঁর স্বপ্নগুলোর গভীরে কী ছিল তাঁর অনুভূতির দেওয়াল লিখন। যে জীবনের গভীরে তাঁর স্বপ্নগুলি ভেসে গেছে মহিমাময় একাকিত্বে। শুধু আমরা অনুভূতির উদারায় আর মুদারায় মনোযোগী হয়ে বুঝতে পারি অচিন্ত্য আইচ, নৈঃশব্দ্য আর মৌনতাকে পরিপক্ব করে তাঁর আত্মজীবনে লেপে দিয়েছিলেন বেদনার এক অভিরূপ। আর যিনি মৃত্যুর আগে সমস্ত লৌকিকতার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে গেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখনও আমরা বহন করে চলেছি তাঁর সমাপ্তির ভার।