সুপ্রভাত ডেস্ক
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ব্যাংকিংখাতের তারল্য সংকটের মধ্যেও ২০২২ সালে শিল্পখাতের ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। কাচাঁমাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও ব্যাংক ঋণের সুদহার কম থাকায় এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো শিল্পখাতে ঋণ বিতরণ করেছে ৫ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ অর্থবছরে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১,০১,৩২১ কোটি টাকা। খবর টিবিএস।
ব্যাংকাররা বলছেন, যুদ্ধের কারণে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তেল, গ্যাসসহ সকল ধরনের পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এছাড়া, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম গত বছরের তুলনায় অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে শিল্প ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
গত ২০২২ অর্থবছরের আগস্ট থেকে আমদানির পরিমাণ কমতে থাকায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২.১৪ শতাংশ, যা গত ১১ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমলেও উল্টো চিত্র দেখা গেছে শিল্পখাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে।
যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোভিডের পর থেকে আমাদের ইজি মনিটরি পলিসি ছিল, এছাড়া ঋণের সুদ কম থাকায় শিল্পখাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।’
তিনি আর আরও বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়ে আমদানির পরিমাণ কমছে। তবে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আমদানি বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। এর ফলে ঋণও বেড়েছে।
‘গ্রাহকরা আমদানি বিল পরিশোধের জন্য বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রা কিনছেন; এতে ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারির তুলনায় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অতি প্রয়োজনীয় ৮ ধরনের পণ্যের গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল- কয়লা ২৮৫ শতাংশ, পেট্রোলিয়াম ৩০০ শতাংশ, লোহা ও ইস্পাতা ২০ শতাংশ, সয়াবিন ৭৬ শতাংশ, গম ৬৩ শতাংশ, চিনি ১০০ শতাংশ, সার ৭৫ শতাংশ, তুলা ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গড়ে ৭৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৪.৪০ ও ৭৮.৯৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এই সময়ে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৪.৫৫ বিলিয়ন ডলার।
অতি প্রয়োজনীয় ৪৬ শতাংশ পণ্য আমদানি জন্য ২০২১ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ২৩.০৫ বিলিয়ন ডলার, একই পরিমাণ পণ্য ২০২২ অর্থবছরে আমদানি জন্য ব্যয় দাঁড়ায় ৪৪.২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ১৯.২৫ বিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ক্যাপিটেল মেশিনারিজ আমদানি অনেক কমে গেছে। গার্মেন্টসগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমদানির পরিমাণ অনেক কমেছে। চলতি ২০২৩ অর্থবছরে ঋণের পরিমাণও কমে যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৭.৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এছাড়া, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকি বিক্রি করেছে ১১ বিলিয়নের বেশি। যার কারণে অতিরিক্ত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ১৯ বিলিয়ন ডলার বেশি পরিশোধ করতে গিয়ে গ্রাহকদের টাকা খরচ হয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে, শিল্প ঋণের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিল্প খাতে মোট আউটস্ট্যান্ডিং ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে ৭ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২.৮৩ শতাংশ। যদিও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এই খাতের ঋণের আউটস্ট্যান্ডিং ছিল ৬ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা বা ১৩.৬৪ শতাংশ খেলাপি।
শিল্প ঋণ গত ২০২২ বছরে বাড়লেও চলতি ২০২৩ সালে কমবে বলে জানিয়েছেন একাধিক ব্যাংকের শিল্প ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা। টিবিএসকে তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জুন থেকে ঋণের সুদহার বাড়াবে। এছাড়া, গত কয়েক মাসে আমদানি কমেছে, যার কারণে শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণও কমবে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে আগের একই সময়ের তুলনায় আমদানি এলসি খোলা প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪৫.৫২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৫৯.৪৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। অর্থাৎ, এলসি খোলা কমেছে ২৩.৪৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য গত ৮ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.৬৮ বিলিয়ন ডলার এলসি খোলা হয়েছে। এইখাতে এসব এলসির পরিমাণ বাড়লে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নতুন ঋণ তৈরি হতো।