নিজস্ব প্রতিবেদক »
‘আমাদের চেতনায় তুমি অমলিন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা-সাহিত্যিক বেগম মুশতারী শফীর প্রথম প্রয়াণ দিবসে ‘স্মৃতিকথা’ শীর্ষক স্মরণসভা। এতে বক্তারা মুশতারী শফীর বিভিন্ন কর্মকা-ের স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যাওয়ার শংকা প্রকাশ করেছেন।
গত ২০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূতিকাগর ‘মুশতারী লজ’ নামক মুশতারী শফীর এনায়েত বাজার বাসভবনে এ সভার আয়োজন করা হয়। প্রদীপ প্রজ্জ্বলেনর মাধ্যমে সভার সূচনা হয়। স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, তাঁর সহযোদ্ধা, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবসহ আত্মীয় ও পরিবা-পরিজন।
বেগম মুশতারী শফীর হাতেগড়া স্কুল ‘হলি ফ্যামিলি টিউটোরিয়াল’-এর শিক্ষক শুভ্রা চৌধুরী বলেন, ‘আপা আমাদের অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর ১বছরের মধ্যে স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কি বলবো, এতো খারাপ লাগছে। উনিও নেই, উনার হাতেগড়া স্কুলটাও নাই হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এই স্কুলের সাথে যুক্ত আমি। খুব কষ্ট হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
ছড়াকার আ. ফ. ম মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘অচিরেই হয়তো এ ভবনটিও বহুতল ভবনে পরিণত হবে। আমার অনুরোধ থাকবে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূতিকাগার ‘মুশতারী লজ’-এর জন্যে অন্তত দুটি রুম বরাদ্দ রাখা হোক। বেগম মুশতারী শফীর জ্যেষ্ঠকন্যা ফারজানা নজরুল বলেন, ‘একটা বছর পার হয়ে গেল আমরা মাহারা। ৭১-এ আমরা বাবাকে হারিয়েছি। আমার মা আমার বাবারও ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাবাকে মুক্তিযুদ্ধের পরে ফিরে পাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু যখন ফিরলেন না, তখন ভয় হতো, যদি মাকেও হারিয়ে ফেলি। আমার মায়ের মধ্যে এমন এক প্রতিভা ছিল যেটিকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি নারীদের কেবল নারীরূপেই দেখতেন না। তিনি চাইতেন নারীরা তাদের কেবলই নারী পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসুক। আপনাদের প্রেরণায় আম্মার আদর্শ জাগ্রত রাখার চেষ্টা করবো। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানাভাবে বিকৃত করার চেষ্টা চলো। সেই পরিবর্তনের সময় আম্মাকে অনেক বিচলিত হতে দেখেছি। সেই উদ্বিগ্নতা থেকে আম্মা একটি স্কুলপ্রতিষ্ঠা করেন। যে স্কুলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য শিক্ষা দেয়াই ছিল মূল লক্ষ্য।’
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিনিধি জামশেদ চৌধুরী বলেন, ‘তাঁর নাম আমি ছোটবেলা থেকেই শুনেছি। বিশেষ করে তাঁর নারী সংগঠনগুলোতে আমার মা যেতেন, সেভাবেই তাঁকে চেনা। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি গঠন করে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামে বেগম মুশতারী শফী ছিলেন সেই কমিটির আহবায়ক। সমগ্র চট্টগ্রামে যেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তির অবস্থান, সেখানে তিনি নিজে গিয়ে সভা ও কমিটি করতেন। গভীর রাত্রে কালুরঘাট ব্রিজের কাছে কদুরখীলের মতো জায়গায় গিয়ে আমরা সভা করেছি তাঁর নেতৃত্বে। সেই আন্দোলনের ফসল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসা। তাঁর স্মরণসভা আরো বৃহৎ পরিসরে আয়োজিত হবে, সে কামনা করছি। তাঁর সাহস ও প্রেরণা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ বলেন, ‘আমরা কল্পনাই করতে পারি না, মুক্তিযুদ্ধের আগে ‘বান্ধবী’ নামে একটি পত্রিকা চালাতেন তিনি। যেখানে সম্পাদনার কাজ থেকে শুরু করে কর্মরত সকলেই ছিলেন নারী। অসীম সাহসিকতার সাথে যেভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তা অনন্যসাধারণ। তিনি কবিতা, গল্প, শিশুসাহিত্যেও উল্লেখযোগ্য রেখেছেন। আমরা গর্বিত রাষ্ট্র তাঁকে রোকেয়া পদকে ভূষিত করেছে।’
কবিÑসাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘দিনের পর দিন অনেক স্বপ্ন দিয়ে অনেক শোক কবিতা রচনা করতে পারবো। বছর বছর স্মরণসভা করে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখতে পারবো। কিন্তু এসব কিছুই একজন মুশতারীর শফীর জন্য যথেষ্ট নয়। যদি না আমাদের মধ্যে যে আত্মপ্রতারণার প্রবণতা বিদ্যমান, তা পরিহার করতে শিখি। যে বাংলাদেশের জন্য তিনি স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন, যে বাংলাদেশের জন্য তিনি সমগ্র জীবন সংগ্রাম করে গেছেন সেই বাংলাদেশ যদি অসাম্প্রদায়িক না হয়, তাহলে তাঁদের সংগ্রামের যর্থার্থ মূল্যায়ন হবে না।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহীম হোসেন বাবুল বলেন, ‘মুশতারী শফি কোনোদিন হাল ছাড়েননি। তিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন-সংগ্রা করেছেন। কাপুরুষ অনেকবার মরে, বীর মরে একবারই। বেগম মুশতারী শফিও একবারই মারা যান। আমার একটা ইচ্ছা, মুশতারী আপার নামে মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্মদের একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারি যেন। বেগম মুশতারী শফীর চেতনাকে আরো শাণিত করতে হবে।’
উদীচী’র ভারপ্রাপ্ত সহসভাপতি ড. চন্দন দাশ বলেন, ‘তিনি উদীচী’র সভাপতি হয়ে আমাকে বললেন, অনেকদিন পর নিজের একটা সংগঠনে ফিরে এলাম। ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা ভিন্ন বিষয়। যদিও অনেক কিছুর সুবিধার্থে আমরা দুটোকে এক করে ফেলি। তিনি বলেছিলেন, তিনি কখনও ধর্মকে এক করে দেখবেন না। রাজনীতির জন্য তিনি কখনও ধর্মকে ব্যবহার করবেন না।’
বেগম মুশতারী শফির জামাতা আব্দুলাহ জাফর বলেন, ‘ভার্জিনিয়া উলফ-এর একটা উপন্যাসের বিষয় ছিল নারীর চোখে যুদ্ধ। নারীরা যুদ্ধকে কিভাবে দেখছেন, তিনি সেটা ব্যাখ্যা করেন। তখন আমার বেগম মুশতারী শফির ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’ বইটার কথা মনে পড়ে। এখানে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা নাম না-জানা অনেক নারীর কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এভাবে তিনি নিজের অসাধারণ জীবনজিজ্ঞাসা, জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতার আলোকে ২২টি বই লিখে গেছেন।