জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা »
এই গ্রামের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আনোয়ারা স্কুলে পড়তাম। তবে স্লুইস গেইট ভাঙনের ফলে অনেকেই আর স্কুলে যায় না। আবার অনেক মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য শহরে চলে গেছে কিন্তু এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ নিম্নবিত্ত যার ফলে গ্রামে থেকেই তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আগে ২০ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম কিন্তু এখন নৌকা ভাড়ায় সেই বিশ টাকা চলে যায় তাই ৩ কিলোমিটার হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা করি। নৌকায় করে বাকখাইন গ্রামে যাওয়ার সময় এভাবে নিজের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বিষয়ে জানাচ্ছিল আনোয়ারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জুঁই দাশ।
শুধু জুঁই নয় স্লুইস গেইট ভাঙার ফলে এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে বাকখাইন গ্রামের কয়েক হাজার বাসিন্দা।
জানা যায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় ইছামতি খালের শাখা দক্ষিণ বাকখাইন নোয়ারাস্তা কান্দুরিয়া খালের ওপর আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেইট। সেটি নির্মাণের এক বছরের মাথায় জোয়ারের পানির ¯্রােতে প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধসহ খালে বিলীন হয়ে যায়। পাশের বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে স্লুইস গেইটের অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু গত দুই বছর যাবৎ এ ব্যাপাওে বেখবর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন।
স্লুইস গেটটি খালের ভিতর তলিয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অন্যদিকে উপজেলার চাতরী, পারৈকোড়া, বারখাইন, আনোয়ারা সদরসহ চারটি ইউনিয়নের হাজার হাজার একর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এই নিয়ে গত দুই বছর ধরে চরম দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার বাসিন্দা। রাত হলে দুর্ভোগ যেন চরমে পৌঁছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্লুইস গেইটসহ প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ পুরোপুরি খালে বিলীন হয়েছে। নৌকা নিয়ে পারাপার হচ্ছে স্থানীয় লোকজন। স্লুইস গেইট ভাঙনের পাশে স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাঁশের সাঁকো দেয়া হলেও পানির স্রোতে তা টেকসই হয়নি। এদিকে স্লুইস গেইটের ভাঙা অংশ দিয়ে বালুর ড্রেজার চলাচল করায় বেড়িবাঁধ আরও ভাঙছে।
স্থানীয়রা জানান, স্লুইস গেইটটি ভাঙার পর থেকে রাতে মেডিক্যালে নিতে না পারায় দুলাল বল নামের এক ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে, সবিতা বল নামের এক মহিলা ডায়াবেটিসে এবং নির্মল বল নামের এক বৃদ্ধ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এছাড়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে।
সমর দাস নামের এক বৃদ্ধ বলেন, এক পোয়া মুড়ির প্রয়োজন হলেও নৌকা দিয়ে পার হয়ে দোকানে যেতে হয়। ছোটো ছেলেমেয়েরা নৌকা দিয়ে পার হয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়। বাকখাইন বললে এখন আমাদের মেয়ের বিয়ে হয় না। ছেলেদের জন্য বউ আনতে পারি না। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য বা ছেলের জন্য বউ আনার জন্য শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়।
রীনা দত্ত নামের আরেক স্থানীয় মহিলা জানান, বর্তমানে আমাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। দিনে পার হলেও রাত ১০ টার পর নৌকা চলাচল করে না। রাতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে করেও হাসপাতালে নেয়া যায় না। অনেকেই গর্ভবস্থার শুরুতে বাপের বাড়ি কিংবা নিকটাত্মীয়দের কাছে চলে যায়।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি’র সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। আশা করি দ্রুত এটার ব্যবস্থা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) চট্টগ্রাম অঞ্চলের আনোয়ারার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) অনুপম দাশ বলেন, স্লুইস গেইটটি মেরামতের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, আশা করি, দ্রুত এটার মেরামত করা হবে।