কামরুল হাসান বাদল »
উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস জন হাফ্যাম ডিকেন্স, যাঁকে বিশ্ব চার্লস ডিকেন্স নামেই চেনে, তিনি তাঁর এ টেল অব টু সিটিস উপন্যাসের শুরুতে লিখেছিলেন, ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অব টাইম, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অব টাইম, ইট ওয়াজ দ্য এজ অব উইজডম, ইট ওয়াজ দ্য এজ অব ফুলিশনেস।
১৯৭১ কিংবা গত শতকের ষাট ও সত্তর দশককে আমরা ডিকেনসের যে অসাধারণ উক্তির সঙ্গে তুলনা করতে পারি। প্রকৃত অর্থে সে দু দশক ছিল বাঙালির বেস্ট অব দ্য টাইম একাধারে ওয়ার্স্ট অব দ্য টাইম। কেন বললাম, তারা একদিকে যেমন ইতিহাসে গৌরব ও অহংকারের অধ্যায় রচিত করে তেমনি আবার কলঙ্ক ও গ্লানির অধ্যায়ও রচনা করে। বাঙালির কিছু দিন আছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতম, বাঙালির কিছু দিন আছে গ্লানি ও কলঙ্কতম।
বাঙালি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসাধারণ বীরত্বগাথা রচনা করেছে যা বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য হিসেবে পরিগণিত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তেমন একটি গৌরবময় দিন। যেদিন বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমন ঘটনা দু চারটি ঘটেনি বিশ্বে। যে কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষাকে ভালোবাসার, মর্যাদাদানের এমন উদ্দীপক দিন কোথায় আছে আর ক্যালেন্ডারে। বাঙালির এই অনন্য গৌরবগাথা আজ বিশ্ব সভ্যতার অংশ হয়ে উঠেছে। তেমনি করে বাঙালি সৃষ্টি করেছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনের বিজয়ানন্দ, একাত্তরের উত্তাল মার্চ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ, যার মাধ্যমে অর্জন করেছে তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
বিশ্বের সকল স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি স্বাধীনতা দিবস থাকে। বাংলাদেশেরও আছে তবে তারও বেশি গৌরবমুখর তার একটি বিজয় দিবসও আছে যা অন্য জাতির নেই। বাঙালি এই গৌরবান্বিত অধ্যায়গুলো সৃষ্টি করার পাশাপাশি কিছু অগৌরব, কলঙ্ক ও গ্লানির অধ্যায়ও রচনা করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর যেমন বাঙালির আনন্দ, গৌরব, অহংকার আত্মশ্লাঘার দিন তেমনি তার পাশাপাশি ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ১৪ ডিসেম্বর বাঙালির আত্মবিনাশ, পরাজয়, আর গ্লানির দিন। গত শতকের ৬০ ও ৭০ দশক ছিল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাল, সুবর্ণকাল এবং একই সাথে গ্লানি ও হতাশার কালও। ডিকেনসের সেই অমর বাক্যটির মতো বেস্ট অব দ্য টাইম, ওয়ার্স্ট অব দা টাইম।
এক একেকটি সময় আসে তখন মনে হয় তা মানবজাতির জন্য অমঙ্গলের, অকল্যাণের সময়। কিন্তু মানুষ এক অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি নিয়ে জন্ম লাভ করেছে। ফলে মানুষ তার সে দুঃসময়কে সহজে অতিক্রম করতে পারে, মানবতার সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে। অনেক যুদ্ধ, অনেক ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেছে মানবজাতি, অনেক দুঃসময়, অনেক কঠিন সময় অতিক্রম করেছে মানুষ। কিন্তু মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর বিখ্যাত ও নোবেলজয়ী উপন্যাস, দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি- তে লিখেছিলেন, মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হয় না। মানুষের ইতিহাস বাস্তবে তাই সাক্ষী দেয়।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা ছিল ‘দ্য বেস্ট অব টাইম’ আর ‘দ্য এজ অব উইজডম’ ফলে কোনো অপশক্তি তাকে ম্লান করতে, ব্যর্থ করতে পারবে না।
এই সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে কম বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়নি। কিন্তু ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বারবার সে বাধা অপসারণে অমিত প্রেরণা যুগিয়েছে। জাতির পিতা একটি শোষণহীন, বঞ্চনাহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সে ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা অপূর্ণ থেকে যাবে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্টার মাধ্যমে সম-অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।
যে অসাধারণ স্বপ্ন, চেতনা ও আদর্শ নিয়ে এই রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল সে রাষ্ট্রটি কখনোই ব্যর্থ হবে না, পথ হারাবে না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ওই মৌলিক চার নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে বাংলাদেশ টিকে থাকবে, জাতির জনকের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।