জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা »
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলের মানুষের জন্য ছিল এক ভয়ানক রাত।
ঘূর্ণিঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিলো না, সারাদিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিলো, সন্ধ্যার আগ থেকে হালকা বাতাস শুরু হয়, বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে রাত দশটার পর থেকে। ঘণ্টা কয়েকের ব্যবধানে রাত ১২টা নাগাদ বাতাসের সাথে সাথে উপকূলে উঠে আসে সাগরের পানি। পানি আসার ১০ মিনিট আগেও কেউ ধারণা করেনি এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমরা তখন বাজারে ছিলাম। পানির খবর পেয়ে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করতেই দেখি দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘরবাড়ি-গাছপালা পানির সাথে ভেসে ভেসে আসছে। তারপর আমরা কয়েকজন একটা ঘরের ছালে উঠে পানির স্রোতের সাথে সরেঙ্গার দিকে চলে আসি। চারদিকে পানির গর্জন। রাতের আঁধারে কিছু বুঝার কুদরত নাই। এভাবেই রাত কেটে গেলো। পরদিন সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে দেখতে পেলাম চারিদিকে লাশ আর লাশ। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের পরিচিত অপরিচিত মানুষের লাশে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আনোয়ারা মৃত্যুপরীতে পরিণত হয়েছে। পরদিন দুপুর হতে হতে পানি নেমে যায়, ভেসে উঠে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত। তিনটা পাকা দালান ছাড়া আর কোনো ঘর বাড়ি অবশিষ্ট ছিলো না আমাদের পুরো ইউনিয়নে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ভেসে আসা লাশগুলোকে গণকবর দেওয়া শুরু হয়। লাশ পচে দুর্গন্ধ বের হওয়ার পর স্থানীয়রা কেউ দাফন করতে না আসায় শহর থেকে মানুষ এনে লাশ দাফন করা হয়েছে। এভাবেই ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন রায়পুর ইউনিয়ন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক মো. আব্দুস সালেক (৬০)।
নিজের মা বাবাসহ পরিবারের ১৮জন সদস্যকে হারিয়েছেন আনোয়ারা উপজেলার সরেঙ্গা এলকার মো. রফিক। তিনি সেদিনকার কথা তুলে ধরে বলেন, তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম, ঘূর্ণিঝড়ের আগে বেড়াতে গেয়েছিলাম খালার বাসায়। খবর শুনে পরদিন এসে দেখি এই ঘূর্ণিঝড়ে আমার মা-বাবাসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য মারা গেছেন। সেই থেকে আজও ২৯ এপ্রিল আসলে সেই ভয়াবহ মুহূর্তের কথা মনে পড়ে যায়।
মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের ৭ সদস্যকে হারিয়েছিলেন রায়পুর এলাকার ওয়াহেদ আলী বাজারের এলকার বাসিন্দা অলি হোসেন (৫০)। সেদিন পানির স্রোতে ভেসে একটা পাকা দেয়ালে উঠতে পারায় বেঁচে গেয়েছিলেন তিনি আর তার বড় বোন রেজিয়া বেগম (৫৫)। তার ভাষ্য মতে সেদিন রাতে তিনি ভেবেছিলাম তার মা-বাবাও হয়তো তাদের মতো বেঁচে আছেন। কিন্তু সকাল হতে সেই আপন মানুষগুলোর একটা একটা মৃত চেহেরা তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেটা কখনো চিন্তা করেননি।
এভাবে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে অনেকেই তাদের আপনজন হারিয়েছেন, কারো তাদের মরদেহ দেখার সুযোগ হয়নি। এখনো ২৯ এপ্রিল আসলে উপজেলার রায়পুর এলাকায় বিভিন্ন স্মরণসভা, দোয়া মাহফিল ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কাটিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল আনোয়ারার উপকূলের মানুষের। সে ঘূর্ণিঝড়ের পর আনোয়ারার উপকূলে প্রচুর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
একই সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে আনার পদ্ধতিও বেশ জোরদার হয়েছে। আগের তুলনায় ঝড়ের সতর্ক সংকেত উপকূলের মানুষের কাছে আরো কার্যকরীভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে ঝড়ের পর বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসাথে এতো মানুষ আর মারা যায়নি। যারা সে ঝড়ের প্রত্যক্ষদর্শী তাদের মন থেকে সে রাতের দুঃসহ স্মৃতি হয়তো কখনোই মুছে যাবে না। সে কারণে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এখনো বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছে ‘ভয়াল রাত’ হিসেবে পরিচিত।
তৎকালীন আনোয়ারা এবং বর্তমান আনোয়ারার মধ্যকার তুলনামূলক পার্থক্য উল্লেখ করে আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, তখন উপকূলে বেড়িবাঁধ ছিলো না, এখন আনোয়ারার চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সাইক্লোন সেন্টার, মুজিবকেল্লাসহ বিভিন্ন আশ্রয়ণকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। সেদিন ঘুর্ণিঝড়ের কোনো পূর্বভাস ছিলো না এখন ঘূর্ণিঝড়ের অনেকদিন আগে তার পূর্বাভাস দেওয়াসহ প্রতিটা মুহূর্তের আপডেট দেওয়া হয়।