আরিফুল হাসান »
জাতীয় সঙ্গীত একটি দেশের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক চেতনার প্রতীক। এটি শুধুমাত্র সঙ্গীতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি প্রকাশ করে না, বরং সে জাতির সংগ্রাম, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের প্রতিফলনও ঘটায়। জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন কেবলমাত্র একটি নতুন সুর বা শব্দের সংযোজন নয়; এটি দেশের আত্মপরিচয় এবং সাংস্কৃতিক মননের গভীরে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। এই প্রবন্ধে, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের ফলে সাংস্কৃতিক মননে কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা আলোচনা করা হবে এবং ঐতিহাসিক কিছু ঘটনার মাধ্যমে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
জাতির হৃদয়ে লুকানো সুরের স্মৃতি
জাতীয় সঙ্গীত একটি দেশের ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। এটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ বা সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের স্মৃতি বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত “জন-গণ-মন” দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত, যা একটি স্বাধীন ভারতের স্বপ্নকে ধারণ করে। এই সঙ্গীত ভারতের মানুষের মাঝে জাতীয় ঐক্য এবং স্বকীয়তার বোধ জাগ্রত করে।
জাতীয় সঙ্গীত এমন একটি সাংস্কৃতিক চিহ্ন যা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা জাগিয়ে তোলে। যখনই কোনো রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক মঞ্চে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়, তখন দেশের জনগণ সেই মুহূর্তে নিজেদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত বোধ করে। এটি জাতির গর্বের প্রতীক এবং জাতীয় পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সুরের অদল-বদল: বিভেদের সুর
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করলে দেশের জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, একটি দেশের জনগণ জাতীয় সঙ্গীতের সাথে নিজেদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে যুক্ত করে দেখে। সঙ্গীতটি বদলে ফেলার ফলে জনগণের মধ্যে অস্থিরতা এবং অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। তাদের মনে হতে পারে যে, নতুন সঙ্গীত তাদের ইতিহাস বা সাংস্কৃতিক চেতনাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করছে না।এছাড়া, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবনমন ঘটে। পুরোনো সঙ্গীতটির সাথে জড়িত স্মৃতি এবং ঐতিহ্য হারিয়েযায়, যা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের সময় এর পুরোনো সংস্করণটির সাথে বিপ্লবী ইতিহাসের স্মৃতি হারিয়ে যায়।
ইতিহাসের পাতায় সুরের পরিবর্তন
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের সাংস্কৃতিক প্রভাব বোঝার জন্য কয়েকটি ঐতিহাসিক উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে।
১. রাশিয়া: ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, রাশিয়া তার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে। সোভিয়েত যুগের সঙ্গীতটি একটি নতুন সঙ্গীত দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, যা সে সময়ের নতুন রাষ্ট্রীয় চেতনার প্রতিফলন ছিল। তবে, অনেক রাশিয়ান এই পরিবর্তনকে তাদের বিপ্লবী ইতিহাসের সাথে বিচ্ছেদ হিসেবে দেখেন এবং এর ফলে দেশের মধ্যে একটি সংস্কৃতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট ভ¬াদিমির পুতিন পুরোনো সঙ্গীতটির সুর ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন, যা সোভিয়েত যুগের স্মৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানাতে সহায়ক হয়েছিল।
২. দক্ষিণ আফ্রিকা: ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সফলতার পর, দেশের নতুন সরকার “দ্য ক্যাল্লার” এবং ‘ন্যাকোসি সিকেলিলি আফ্রিকা’ নামক দুটি পুরোনো গানকে একত্রিত করে নতুন জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করে। যদিও এটি একটি সমন্বিত সঙ্গীত হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার বহু ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান জানায়, তবে অনেক পুরোনো জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এই পরিবর্তনকে তাদের ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান হিসেবে দেখেছিল। ফলে দেশের মধ্যে এক নতুন সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
৩. কানাডা: কানাডার জাতীয় সঙ্গীত ‘ও কানাডা’ ১৯৮০ সালে সরকারিভাবে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে, এর কিছু অংশের ভাষা এবং সুর নিয়ে বিতর্ক হয়, বিশেষ করে ভাষাগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের মধ্যে। ২০১৮ সালে, সঙ্গীতের একটি লাইন পরিবর্তন করা হয় যাতে এটি আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। যদিও এটি সমসাময়িক কানাডিয়ান সমাজের মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে, তবু এই পরিবর্তনটি অনেকের কাছে ঐতিহ্যের সাথে বিরোধ বলে মনে হয়েছিল।
ঐক্যের সুরে স্খিতিশীলতার কাব্য
একটি দেশের সাংস্কৃতিক মনন স্থিতিশীল রাখতে জাতীয় সঙ্গীতের ভূমিকা অপরিসীম। সঙ্গীতের মাধ্যমেই দেশের জনগণ নিজেদের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের সাথে সংযুক্ত থাকে। জাতীয় সঙ্গীতের যে কোনো পরিবর্তন জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন বিশেষত সেই সমস্ত দেশগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, যাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির মধ্যে গভীর বৈচিত্র্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মতো একটি বহুজাতিক দেশে, জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন করলে দেশের বিভিন্ন জাতি, ভাষা এবং সংস্কৃতির মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকে। একইভাবে, আফ্রিকার কিছু দেশে জাতিগত বিভেদের কারণে জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন সেই বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
শেকড়ের সংস্কৃতি
জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন একটি দেশের সাংস্কৃতিক মননের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি জনগণের মধ্যে বিভাজন এবং সংস্কৃতিক সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি যে, জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন কখনো কখনো দেশের মধ্যে অ¯ি’রতা এবং সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তাই, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের আগে দেশটির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জনগণের আবেগের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। একটি দেশের সাংস্কৃতিক স্থিতিশীলতা এবং ঐক্য রক্ষার জন্য জাতীয় সঙ্গীত একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, এবং এর পরিবর্তন খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়।