দেবাশিস ভট্টাচার্য »
সুকান্ত হাঁটতে থাকে। ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটারও একটা মজা আছে। এটা আসলে একটা খেলা। কিন্তু এ মুহূর্তে সুকান্ত খেলছে না। তার খুব মন খারাপ, কিছুই ভালো লাগছে না। ভেতরে ভেতরে সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
এসময় সুকান্তের সাথে হেঁটে যাওয়া ছায়াটার ঠোঁট নড়ে ওঠে-
সুকান্ত, তুই কই যাবি?
জানি না, যেদিকে দু চোখ যায়। এখানে আর থাকবো না আমি।
তোকে তো কেউ খুঁজতে যাবে না, তোরতো আর আপন কেউ নেই। অহেতুক পথ হারাবি, সব হারাবি তুই —
আমিও হারিয়ে যাবো বাবার মত, এ পথের শেষ যেখানে আর ফিরবো না কোনদিন।
সুকান্ত এভাবেই পথে পথে হাঁটতে থাকে। একটা নীল বিষন্নতা তাকে যেন গ্রাস করে আছে।
ছোট বেলার কথা মনে পড়ে তার। মার পাশে বসে সাত রাজ্যির গল্পের খই ফুটছে তার মুখে। তার কপালে হীরের টায়রা, রাজার পোশাকপরা ছোট্ট রাজকুমার সে তখন।
মা আমার ঘোড়া কই? টগবগ করে ছুটাতাম-
বড় হলে চড়তে পারবে।
মা নাকের নথ দুলিয়ে হেসে হেসে আদর করছিল তাকে।
কী পবিত্র সাদা দাঁতের মুক্তোর মত হাসি ছিল মার।
সেই মা আজ নেই, বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন বাবার শোকে। দুঃখিনী মা আমার শোককে জয় করতে পারেননি।
এসময় আপনা আপনি একটা প্রতিবন্ধকতা এসে যায় সুকান্তের ভেতর। তার ছায়াটা দাঁড়িয়ে যায়।
কাছেই শহীদ মিনার। পরিস্কার করা হয়েছে সকালে।
সামনের একটা ফাঁকা জায়গা তাকে ডাকে।
হতচ্ছারা আয়, এদিকে আয়তো দেখি —
এখানে বসলে তোর মন থেকে সব দুঃখ চলে যাবে। বড় শিরিস গাছটায় পিট দিয়ে চুপচাপ বসে থাক। আকাশের দিকে তাকা, আকাশের বিশালতা দেখ, যা মানুষের দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। মনকে সমৃদ্ধ করে।
কে বলছে এসব! বাবা নয়তো?
খুব কৌতূহল হতে থাকে সুকান্তের। বোন রিক্তার কথা মনে হতেই ভীষণ কান্না পেলো তার। সে হয়তো তাকে না দেখে খুব কাঁদছে। রিক্তা মামার মেয়ে, তাকে খুব ভালোবাসে।
মামুর সময় কম। দোকান আছে গঞ্জে। ঘরে থাকেন কম। বড় ভালো মানুষ তিনি। কিন্তু মামি সম্পূর্ণ বিপরিত। ওনার নির্দয় ব্যবহার সুকান্তকে আজ পথে নিয়ে এসেছে। মা মারা যাবার পর থেকে মামার ওখানেই ছিল সুকান্ত।
বাবাকে মেরে ফেললো ওরা, আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন রাজার হালে থাকতো সে।
বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, স্বাধীনতার শত্রুরাই বাবাকে মেরেছে পেছন থেকে মা বলতেন সবসময়। সেদিন ছিল বিজয় দিবস। সেদিনই ঢাকা থেকে রাতে ফেরার সময় বাবাকে মেরে ফেলে তারা।
মা বলতো বাবার কোন শত্রু ছিল না, তবে নির্দোষ বাবাকে কেন হত্যা করেছিল অনেক ভেবেছে সে। এ দেশকে ভালবাসতো বাবা, তাই একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল এদেশ স্বাধীন করতে। এটাই কাল হলো, স্বাধীনতার এতবছর পরও বাবা খুন হলো। জীবন অনেক কিছু দেয় আবার ছিনিয়েও নেয় এটাই যেন সত্য হলো তার জীবনে।
বাবার সব কথা মনে নেই সুকান্তের, তবুও ভাবে বাবার মত কিছু করবে দেশের জন্য।
তবে কি সুকান্ত আবার ঘরে ফিরে যাবে?
আজ সারারাত ঘুম আসবে না তার
ফুল দিতে হবে বাবাকে
সুকান্ত ফিরবে