বাজারে চাল ও পেঁয়াজের দাম বাড়াটা কোনো স্বাভাবিক বিপর্যয় বা ঘাটতি থেকে উদ্ভূত নয়, এটি দেশে সক্রিয় সিন্ডিকেট সমূহের কারসাজি। বিষয়টি সুদীর্ঘকাল থেকে এদেশের সচেতন মানুষ গণমাধ্যমের বদৌলতে ওয়াকেবহাল থাকলেও তার কোনো হদিশ পেতে শোনা যায়নি এতদিন। সকল সরকার এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদ্গার করে গেলেও এদের টিকিটি কেন পাওয়া যায় না, তা মালুম হয় না সাধারণ মানুষের। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই সিন্ডিকেটওয়ালারা দেশের সমস্ত আইনকানুন ও শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নজর ও অভিযান এড়িয়ে কীভাবে বহাল তবিয়তে তাদের কালো কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে, এ রহস্য সম্ভবত রোজ কিয়ামতের আগে উদঘাটন হবে না।
তবে এই গৎবাঁধা ব্যাপার-স্যাপারের ভেতরে এক নতুন আশার আলো দেখা গেল সম্প্রতি।
গত মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর গবেষকদের একটি দল ‘বাংলাদেশের চাল, আলু ও পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ও দামের অস্থিরতা : একটি আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন -২০২০’ প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনেই ওই সিন্ডিকেটের তৎপরতার কথা ওঠে এসেছে। তারা বলছেন : ‘বাজারে সাম্প্রতিক কালে চাল ও পেঁয়াজের দাম যে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, তার কারণ ছিল সিন্ডিকেট। অন্যদিকে আলুর দাম বেড়ে যায় কয়েকদফা হাতবদলের কারণে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পণ্যটির চাহিদা বাড়তে পারে, এই ধারণা থেকে একদল ব্যবসায়ী হিমাগারে রাখা আলু কিনে নিয়েছিলেন। সরকার এই সিন্ডিকেট চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দাম এতটা বাড়ত না।’ প্রতিবেদনটিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও বেদনাবহ যে-তথ্যটি ওঠে এসেছে, তা হলো : এইসব সিন্ডিকেটের হোতারা প্রতি কেজি চাল বিক্রিতে ৫ থেকে ১০ টাকা মুনাফা করেন। ভোক্তারাও বেশি দামে ক্রয় করেন, কিন্তু এই বাড়তি দামে কৃষক খুব একটা লাভবান হয়নি। ওই গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি সামলানোর জন্য খাদ্য অধিদপ্তর সরকারি গুদামে যথাসময়ে এবং যথেষ্ট পরিমাণে চালের মজুত বাড়াতে পারেনি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে পেঁয়াজ ও আলু বিক্রি করা যায়নি। ফলে সরকার বাজারে প্রভাব তৈরি করে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
এই জরিপচালনাকারী এবং প্রতিবেদন রচনাকারীদের প্রত্যেকেই সরকারি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ সরকারের খাস লোকজন। কাজেই তাদের অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও তথ্য উদঘাটনে সত্যের অনেকটাই কাছাকাছি থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই। এইদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আবারও প্রগাঢ়ভাবে প্রমাণিত হলো। এই গবেষণা থেকে আরও যে করুণ চিত্রটি পাওয়া গেল, তা হলো, সিন্ডিকেটধারীরা বিপুলভাবে মুনাফার অধিকারী হলেও ক্রেতা তথা ভোক্তা এবং কৃষকসমাজের মেরুদ- ভেেেঙ যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ ক্রেতার চাইতেও অধিক।
এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টমহল সচেতন হলে দেশ বাঁচে, সেই সঙ্গে কৃষকও অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
মতামত সম্পাদকীয়