সুপ্রভাত ডেস্ক »
ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্নাকে শুরুতেই হারানোর ধাক্কা কী দারুণভাবেই না সামলে নিল বাংলাদেশ। বদলি নামার চার মিনিট পরই চোখ ধাঁধানো গোল উপহার দিলেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে পরে জালের দেখা পেলেন কৃষ্ণা রানী সরকার। দ্বিতীয়ার্ধে নেপাল ঘুরে দাঁড়ানোর কিছুটা ইঙ্গিত দিল বটে, কিন্তু ইতিহাস গড়ার নেশায় পেয়ে বসা বাংলাদেশকে রোখার সাধ্য আছে কার! সেই তাড়নার স্রোতে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম শিরোপার উল্লাসে ভাসলেন সাবিনা-কৃষ্ণারা। হিমালয়ের দেশে হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা এই বাংলাদেশকে থামানোর সাধ্য যে নেপালের ছিলই না।
কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সোমবার ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। জোড়া গোল করেন কৃষ্ণা, এক গোল শামসুন্নাহার জুনিয়রের। খবর বিডিনিউজের।
২০১৬ সালে শিলিগুঁড়ির ফাইনালে স্বাগতিক ভারতের কাছে হেরে স্বপ্ন ভেঙেছিল বাংলাদেশের। এবার গোলাম রব্বানী ছোটন মরিয়া ছিলেন লক্ষ্য পূরণে। নেপালের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে তা পূরণ করেই ছাড়ল বাংলাদেশ।
এ নিয়ে পাঁচবার মেয়েদের সাফের ফাইনালে হারের তেতো স্বাদ পেল নেপাল।
১৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন দশরথের গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, নেপালি সমর্থকদের আধিপত্য ছিল। নেপালে থাকা ফুটবলপাগল বাংলাদেশিরা সংখ্যায় অল্প হলেও এসেছিলেন সাবিনা-কৃষ্ণাদের জন্য গলা ফাটাতে।
ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে ভারি বৃষ্টিতে মাঠ হয়ে যায় কর্দমাক্ত, ভারি। ফলে দুই দলেরই সমস্যা হয় বলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে।
প্রথম মিনিটে আক্রমণ শাণিয়ে নেপালকে ভড়কে দেয় বাংলাদেশ। মারিয়া মান্দার বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট গোলরক্ষক আটকালেও পুরোপুরি গ্লাভসে জমাতে পারেননি। আলগা বলে স্বপ্নার শটেও কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আঞ্জিলা থুম্বাপো সুব্বো। এরপরই পাল্টা আক্রমণে ওঠা নেপালের প্রচেষ্টা অনেকটা লাফিয়ে গ্লাভসে নেন রুপনা চাকমা।
নবম মিনিটে শরীর ঘুরিয়ে মারিয়ার জোরালো ক্রসে বক্সের ভেতর বল পেয়ে যান কৃষ্ণা; ভারত ম্যাচে এক গোল করা এই ফরোয়ার্ডের শট সরাসরি যায় গোলরক্ষকের গ্লাভসে।
ডান পায়ের চোট থাকায় স্বপ্নার খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে খেলতে নামে বাংলাদেশ। কিন্তু দশম মিনিটে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়েন স্বপ্না; বদলি নামেন শামসুন্নাহার জুনিয়র।
স্বপ্নাকে হারানোর এই শঙ্কার কালো মেঘ চতুর্দশ মিনিটে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। দুর্দান্ত গোলে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দে ডানা মেলেন শামসুন্নাহার। সানজিদা খাতুনের শট এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে পেয়ে যান মনিকা। একজনকে কাটিয়ে বাইলাইনের একটু উপর থেকে তিনি ক্রস বাড়ালেন বক্সে, শামসুন্নাহারের দুরন্ত ফ্লিকে জাল খুঁজে পায়। টুর্নামেন্টে নেপালের জালে এটাই প্রথম গোল।
একটু পর মারিয়ার কোনাকুনি শট ক্রসবারের উপর দিয়ে উড়ে যায়।
গোল শোধে মরিয়া হয়ে ওঠে নেপাল। মাঝমাঠে মারিয়া-মনিকার নিয়ন্ত্রণে একটু টান পড়ে; ফলে বাংলাদেশের রক্ষণে চাপ দিতে থাকে স্বাগতিকরা। কিন্তু পোস্টের নিচে রুপনা ছিলেন দারুণ ক্ষিপ্র, বিশ্বস্ত। ২৩তম মিনিটে অনিতার শট প্রথম দফায় আটকে দ্বিতীয় দফায় গ্লাভসে নেন তিনি।
এর মধ্যেও সুযোগ পেলেই বক্সের বাইরে থেকে চেষ্টা করছিলেন মারিয়া। ২৭তম মিনিটে এই মিডফিল্ডারের একই চেষ্টা আটকান সুব্বো। এরপর অনিতা কেসির শট প্রতিহত করেন রুপনা।
৩৪তম মিনিটে আবারও রুপনার ঝলক। বক্সের বাইরে অনিতার ছোট ফ্রি কিকে দিপা সাশির শট ঝাঁপিয়ে পড়ে কর্নারের বিনিময়ে ফেরান গোলরক্ষক। এই কর্নার থেকে ডিফেন্ডারদের দৃঢ়তায় বেঁচে যায় বাংলাদেশ। গোললাইন থেকে বিপদমুক্ত করেন ডিফেন্ডাররা।
৪১তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের ভুলে বল পেয়ে অধিনায়ক সাবিনা পাস বাড়ান কৃষ্ণার উদ্দেশে। প্রথম ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটু এগিয়ে বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে লক্ষ্যভেদ করেন এই ফরোয়ার্ড।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে অনিতা কেসিকে তুলে দলের তারকা ফরোয়ার্ড সাবিত্রা ভান্ডারিকে নামান নেপাল কোচ। একটু পরই রুপনার দৃঢ়তা আর পোস্টের বাধায় বেঁচে যায় বাংলাদেশ।
৫১তম মিনিটে ভালো একটি সুযোগ নষ্ট হয় নেপালের; ডান দিক থেকে রাশ্মিকা ঘিসিংয়ের ক্রসে অনিকা বাসনেতের হেড যায় পোস্টের বাইরে। সারাক্ষণ ‘নেপাল-নেপাল’ শ্লোগানে গ্যালারি মাতিয়ে রাখা সমর্থকদের চুপসে যায়।
৬২তম মিনিটে গোলমুখের সামনে শামসুন্নাহার জুনিয়র বল নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে হয়তো ম্যাচের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। তার ব্যর্থতায় এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল নিয়ন্ত্রণে নেন নেপাল গোলরক্ষক।
৭০তম মিনিটে ঘুরে দাঁড়ানো গোল পায় নেপাল। বক্সের ভেতরে ফাঁকায় বল পেয়ে জোরাল কোনাকুণি শটে লক্ষ্যভেদ করেন বাসনেত। রুপনা ঝাঁপিয়ে পড়েও বলের নাগাল পাননি। টুর্নামেন্টে এই প্রথম গোল হজম করল বাংলাদেশ।
দুই মিনিট পর বক্সের বাইরে এসে কর্নারের বিনিময়ে বল ক্লিয়ার করেন রুপনা।
প্রতি আক্রমণ থেকে ৭৭ তম মিনিটের গোলে নেপালকে কোণঠাসা করে ফেলে বাংলাদেশ। সতীর্থের থ্রু পাস ধরে ঠা-া মাথায় নেপাল গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়া দূরের পোস্টে বল পাঠিয়ে উল্লাসে মাতেন কৃষ্ণা।
এরপর ঘড়ির কাঁটা যতই গড়িয়েছে, নেপাল একটু একটু করে ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাফে তো বটেই নেপালের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথম জয়ের গল্প লিখে মাঠ ছেড়েছে মেয়েরা।
নেপালের বিপক্ষে আগের ৮ দেখায় বাংলাদেশের হার ছিল ৬টি, ড্র দুটি। সাফের সবশেষ দেখায় ২০১৯ সালে বিরাটনগরে সেমি-ফাইনালে স্বাগতিকদের দল হেরেছিল ৩-০ গোলে। গত বছর সেপ্টেম্বরে নেপালে এসে খেলা দুই ম্যাচের একটিতে ২-১ ব্যবধানের হার, অন্যটি গোলশূন্য ড্র।
প্রথম শিরোপা জয়ের গল্প লেখার পথে বিরাটনগরের হারের মধুর প্রতিশোধও নেওয়া হয়ে গেল বাংলাদেশের!