হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন’র জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি বান্দাদের হেদায়তের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যাঁর সৃষ্ট প্রত্যেক বস্তু তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে। কৃতজ্ঞতা সেই প্রভুর, যিনি অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষের মাথায় পরিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের রাজমুকুট।
আমরা মুমিন বান্দা কায়মনোবাক্যে স্বীকার করি যে, আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ তাআলাই একমাত্র উপাস্য। ইবাদত শুধুই তাঁর জন্য, যাতে আর কারো অংশীদারিত্ব নাই। আল্লাহ্ই রিয্কদাতা, পালনকর্তা। তাঁর হুকুম ছাড়া মাটিতে বপন করা একটি বীজও অঙ্কুরিত হয় না। আমাদের নিকট তাঁর নির্দেশ আনয়নকারী, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম আলোর দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রথম ও প্রধান বান্দা এবং শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
পৃথিবীতে মানুষ অসংখ্য মতবাদে বিভক্ত থাকলেও সর্বশেষ পরিণতিতে অর্থাৎ প্রলয়Ñপরবর্তীতে থাকবে শুধু দু’টি দল। আমাদের এ বিশ্বাসের ভিত্তি পবিত্র কুরআন। যাতে রয়েছে, ‘একদল হবে জান্নাতে, আরেক দল জাহান্নামে’। আর এটা নিশ্চিত যে, জান্নাতে থাকবেন আল্লাহ্র বিশ্বাসী বান্দাগণ, আর অবিশ্বাসীরা থাকবে জাহান্নামে। বিশ্বাসীদের পারিভাষিক নাম মুমিন, আর অবিশ্বাসীরা কাফির। যাঁর রাসূলের কথাতেই অদেখা এক আল্লাহ্তে অকপটে বিশ্বাস করেন, তাঁরাই মুমিন। যারা তাঁর বাণী প্রত্যাখ্যান করে, তারাই কাফের। এমন সম্প্রদায় নেই, যারা নবী-রাসূল হতে ‘একত্ববাদ’র আহ্বান পায়নি। আল্লাহ্র প্রেরিত নবী কিংবা রাসূল আল্লাহ্র ইবাদত করতে বলেন, অন্যসব কিছুর উপাসনা হতে মুক্ত থাকতে বলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে একজন রাসূল এ নির্দেশনা সহকারে প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহ্র ইবাদত করো, আর শয়তান হতে বেঁচে থেকো। তখন তাদের কাউকে আল্লাহ্ হেদায়ত বা সঠিক পথ প্রদর্শন করলেন, আর তাদের কারো ওপর পথভ্রষ্টতা ঠিকই আপতিত হয়েছে’। (সুরা নাহ্ল : আয়াত-৩৬)
আল্লাহ্ তাআলা নিরাকার। কিন্তু বহু মানুষ এটা মুখে স্বীকার করলেও মনে মনে নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে তাঁর একাট আকৃতির কথা ভাবে এবং এক কল্পিত ছবি বাইরেও রূপ দিতে সচেষ্ট হয়। এমন কি তাঁর কল্পিত মূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করে। যুগে যুগে তাই নবী রাসূল প্রেরণ করে আল্লাহ্ মানুষের সৃষ্ট সাকার উপাস্য স্থির করা যে শির্ক, সেটাই প্রতিষ্ঠা করতে তাঁদেরকে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। এ চ্যালেঞ্জে বহু নবীÑরাসূল ভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর হাতে নির্মম শাহাদতও বরণ করেন। যেমন, বনী ইসরাঈল এক সকালে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে তেতাল্লিশ জন নবীকে শহীদ করে দেয়। তাদের এ জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষিতে সম্প্রদায়ের একশো বারোজন আবেদ বান্দা তাদেরকে এহেন অপরাধ থেকে তাওবা করে সৎকর্মে নিয়োজিত হবার নসীহত করলে তারা সেদিনের সন্ধ্যাতেই তাঁদের হত্যা করে। তাদের এ ঘটনার কথা সুরা আ-লে ইমরান’র ২১তম আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। এতে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ প্রদত্ত হয়। প্রত্যেক নবীর দায়িত্বে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বর্তায়, তাহলো উম্মতকে এক আল্লাহ্র ইবাদতের নির্দেশ দেয়া এবং শির্ক’র মত চরম গর্হিত কাজে বাধা প্রদান করা। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ বা অন্যকিছুকে উপাস্য জ্ঞান করাই শির্ক। এ বড় অনাচার লা-শরীক আল্লাহ্র ঘোষণা, ‘শির্ক নিঃসন্দেহে জঘন্য অনাচার’। মুসা (আ.)র সম্প্রদায়ও তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতিতে গোÑবাছুর’র মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে শুরু করে। সে প্রসঙ্গেও আল্লাহ্র ফয়সালা, ‘তারা ছিল যালিম’। (৭:১৪৮)
আমাদের ইবাদতের সময়ে ক্বিবলা হল কা’বা শরীফ। আমরা জানি, কা’বা শরীফের অভ্যন্তরেও পৌত্তলিক গোষ্ঠী তিন শো ষাট দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন করেছিল। আল্লাহ্র রাসূল যেগুলোকে সেখান থেকে অপসারণ করেন। তখন রাসুলুল্লাহ্ (দ.)র পবিত্র মুখে ধ্বনিত ছিল কুরআন মাজীদের আয়াত ‘জা-আল হাক্বুওয়া যাহাক্বাল বাত্বিল, ইন্নাল বাতিলা কানা যাহুক্বা’।
হজ্বের ফরযত্রয়ের একটি বাইতুল্লাহ্র তাওয়াফ। হজ্বের ওয়াজিব সমূহ ছয়টি। যথাÑমুযদালিফায় ওকুফ, শয়তানকে পাথরÑকঙ্কর মারা, (যা ‘রমিউল জিমার’ নামে পরিভাষায় পরিচিত)। ক্বিরান বা তামাত্তু’ হজ্ব পালনকারীর কুরবানী বা দম, হালাক বা মাথা মু-ানো, সাফা-মারওয়ার সাঈ এবং বহিরাগত হাজীদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ।
বাইতুল্লাহ বা খানায়ে কা’বার প্রসঙ্গ হজ্বের মওসুম হিসাবে ব্যাপকভাবে পূর্বে বর্ণিত হয়। কা’বা শরীফের মত সাফা-মারওয়াতেও স্থাপিত ছিল দু’টি মূর্তি। যে সাফা-মারওয়ার সাঈ হজ্বের ছয় ওয়াজিবের অন্যতম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা সুস্পষ্ট। মহাপরাক্রমশালী, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়, সাফা-মারওয়া আল্লাহ্র নিদর্শনগুলোর অন্যতম। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র ঘরের হজ্ব, অথবা ওমরা সম্পাদন করে, তার জন্য এগুলো প্রদক্ষিণ করাতে কোন পাপ নেই। আর যে ব্যক্তি স্ব-প্রণোদিত হয়ে কোন পুণ্যকাজ করে, তবে আল্লাহ্ তা বিনিময়দাতা, সর্বজ্ঞ’। সুরা বাকারার এটি ১৫৮তম আয়াত।
সাফাÑমারওয়ার সাঈ করায় দোষনীয় বা গুনাহ্র কাজ তো নয়Ñই, বরং তা শুধু পুণ্যই নয়, একেবারে হজ্বের একটি ওয়াজিব। ওমরাতেও তা ওয়াজিব। আয়াতের বাচনভঙ্গিতে বুঝা যায়, এর নেপথ্যে কথা রয়েছে, নচেৎ ‘পাপ নয়’Ñএটা বলা হল কেন? আয়াতের তাফসীর পাহাড়দ্বয়ের পূর্বাবস্থার দিকে ইঙ্গিত প্রছন্ন। পবিত্র কা’বা ঘরে পূর্বদিকে পরস্পর মুখোমুখি অবস্থিত মক্কা মুকাররামার দু’টি প্রসিদ্ধ পাহাড় সাফা ও মারওয়া, যা ‘জবলে আবু কুরাইস’ নামক পাহাড়ের পাদদেশেই। বর্তমানে যা দু’টি উঁচু ঢিবির মত দেখায়। কা’বা শরীফের পূর্বদিকে তাকালে ডানে সাফা, বামে মারওয়া। সাতবার চক্কর সাফা থেকে শুরু হয়ে মারওয়ায় শেষ হয়। তৃষ্ণার্ত শিশুপুত্র হযরত ইসমাঈল’র পানির সন্ধানে ব্যাকুল জননী হযরত হাজেরা (আ.) উভয়ে পাহাড়ে ছুটাছুটি করেছিলেন, ওদিকে শিশুপুত্রের পদাঘাতে নির্গত হয় যমযম কূপ। আর অনাগতকালের প্রতিটি হজ্ব পালনকারীর ওপর স্থায়ী নির্দেশে পাহাড়দ্বয়ে সাঈ বা দ্রুত পা’য় প্রদক্ষিণ করা ওয়াজিব (অপরিহার্য) হয়ে যায়।
আয়াতে দু’টি পাহাড়কে ‘আল্লাহ্র নিদর্শন বলা হয়েছে। সে নিদর্শনদ্বয় প্রদক্ষিণ করাতে অবশ্যই পুণ্য রয়েছে, দোষের অবকাশ কী? তার উত্তর পেতে শানে নুযূল বা আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট দেখতে হবে। আইয়ামে জাহেলিয়ত বা অজ্ঞতার অন্ধকার যুগে পাহাড় দুটিতে স্থাপন করা হয় দু’টি বিশেষ মূর্তি। সাফায় স্থাপিত পুরুষের মূর্তিটির নাম ছিল ‘আসাÑফ’। আর মারওয়াতে স্থাপিত নারী মূর্তির নাম ‘নাÑয়েলা’। পাহাড়দ্বয় প্রদক্ষিণ কালে কাফিররা মূর্তি দু’টির গায়ে হাত বুলাতো এবং এটা বড় পুণ্য কাজ বলেও মনে করতো।
আমাদের নবীজি যখন এখানে ইসলাম’র বিধিÑবিধান প্রতিষ্ঠিত করতে এলেন মূর্তিগুলো উৎপাটন করা হল। হযরত ইবরাহীম (আ.)র পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)’র বংশধারায় আবির্ভূত হলেন খলীলুল্লাহ্’র প্রার্থনার মূর্ত প্রকাশ আমাদের প্রিয়নবী, তাঁর দ্বীন ইবরাহীম (আ.)র মিল্লাতের কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত। মূর্তি উৎপাটনের নবুওয়তী কর্তব্য সম্পাদন করতে ইবরাহীম (আ.) কে নমরূদ বাদশার অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। হাসিমুখে তিনি সেই কঠিনতর কাজ সম্পন্নও করেন। মানুষের গড়া পুতুলকে উপাস্য মানার ধর্ম স্বীকার করেননি আমাদের প্রিয় নবীও আসাফ ও না-য়েলার মূর্তি উৎপাটিত করলেন। যেহেতু, এখানে শির্ক’র মহোৎসব চলতো, সেখানে সাঈ বা পদসঞ্চালনা হজ্বের ওয়াজিব হিসাবে পালন কি আবার আগের ধর্মের আচার’র মত হয়ে যাবে? এ আশঙ্কায়, সন্দেহের দোলায়মান মনে প্রশ্ন জাগছে। তাদের ইতস্ততঃ মনোভাব দূর করতে অন্তর্যামী আল্লাহ্ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন।
কা’বা হতে মূর্তি সরানোর পর যেভাবে তাওয়াফের জন্য তা পবিত্র করা হয়েছে, অনুরূপ, সাফা-মারওয়া হতে পাথরমূর্তি সরানোর ফলে তাও ফের সাঈ করার জন্য পবিত্র, এতে কোন গুনাহ্র অবকাশ নেই। আয়াতালোকে মাসআলা সাব্যস্থ বা স্থির হয় যে এখানে সাঈ বা প্রদক্ষিণ করা ওয়াজিব। এ কাজটি নবীজি গুরুত্বের সাথে সমাধা করেছেন। তাই, সাফা-মারওযার সাঈ করতে না পারলে ‘দম’ অর্থাৎ কুরবানী ওয়াজিব হবে।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।