সুপ্রভাত ডেস্ক »
বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকশ’ বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিটের তৈরি ‘দ্য মিনিস্টার’স মিলিয়নস’ নামে একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। কয়েক মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়েকশো বিলাসবহুল বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি, কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা, ইটালিয়ান স্যুট প্রভৃতি।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে ২৫ মিনিট ১১ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের এই প্রতিবেদনটি আল-জাজিরা ইংলিশ-এর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে।
যুক্তরাজ্যে বাড়ি কেনার জন্য সাইফুজ্জামান বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করেছেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি দেশটিতে ২৬৫টি বাড়ি কিনেছিলেন। ২০২২ সালে তিনি সেখানে কিনেছেন ৮৯টি বাড়ি। সবমিলিয়ে যুক্তরাজ্যে তার বাড়ি রয়েছে ৩৬০টি, যার দাম ২৫ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা)।
সাইফুজ্জামান ২০১৪ সালে হাসিনা সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সালে ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এই পদে তিনি ছিলেন ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
আল-জাজিরার সাংবাদিকদের কাছে তার বিলাসী জীবনের গল্পও করেছেন সাইফুজ্জামান। নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা টেইলর-মেড জুতা। আমি হ্যারডসেও কাস্টম মেড জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটা বানাতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটা তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।’
বিশেষ এই জুতা উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি বলে জানান সাইফুজ্জামান। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে বানানো জুতাগুলোর দাম পড়ে ৬ হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও অর্ধেক বাছুরের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতার দাম পড়ে ৩ হাজার পাউন্ড।
আল-জাজিরার অনুসন্ধান অনুযায়ী, লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পত্তির দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন সাইফুজ্জামান। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের খতিয়ান উঠে এসেছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিকরা গত বছর সাবেক এই মন্ত্রীর সঙ্গে তার লন্ডনের ১৪ মিলিয়ন ডলার দামের বাড়িতে দেখা করেন। সেখানে সাইফুজ্জামান কুমিরের চামড়া থেকে হাতে বানানো জুতা ও ইটালিয়ান স্যুটের জন্য হাজার হাজার ডলার খরচ করা নিয়ে গর্বভরে কথা বলেন।
লন্ডনে সাইফুজ্জামানের বাড়িগুলোর বিষয়ে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য তিনি বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সাবেক এই মন্ত্রী যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন।
এছাড়া সাইফুজ্জামান ২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও সম্পদ কেনেন। ২০২০ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ৩২০ মিলিয়ন ডলার।
আল-জাজিরার সাংবাদিকরা ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ছদ্মবেশে সাইফুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রিপনের সাথে যোগাযোগ করেন। তারা চীন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
রিপন আল-জাজিরার সাংবাদিকদের সাথে লন্ডনের একটি হোটেলে দেখা করেন এবং সাইফুজ্জামানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘যা আপনারা চান, তার (সাইফুজ্জামান) জন্য আমি সেটা করেছি।’
রিপন আরও জানান, সাইফুজ্জামান সবসময় সতর্কতার সাথে কাজ করেন এবং বড় প্রকল্প এড়িয়ে চলেন, যাতে কারও নজরে পড়ে না যান।
আল-জাজিরার সাংবাদিকরা সাইফুজ্জামানের আইনি পরামর্শদাতাদের সাথে দেখা করে এবং জানতে পারে, তার কোম্পানির মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আইনি কাজগুলো একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী পরিচালনা করছেন। ওই আইনজীবী ২০২১ সাল থেকে সাবেক মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের ১০০টিরও বেশি ঋণ-সংক্রান্ত আইনি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
রিপন আরও জানান যে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বার্কলি হোমস থেকে তার মোট সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ কিনেছেন এবং দুবাইয়ে ৫৪টি সম্পত্তি তার মালিকানায় রয়েছে।
রিপনকে সঙ্গে নিয়ে সাইফুজ্জামানের সঙ্গে তার লন্ডনের বাড়িতে দেখা করে আল-জাজিরা অনুসন্ধানী দল। সেখানে সাইফুজ্জামান নিজে স্বীকার করেন যে, তিনি তার সব মুনাফা দুবাই ও লন্ডনে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি আরও বলেন, দুবাইয়ের ডাউনটাউনে তার পেন্টহাউস এবং সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তি রয়েছে।
তবে বাংলাদেশ থেকে এত অর্থ কীভাবে বিদেশে আনলেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফুজ্জামান বলেন, দুবাইয়ে তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে লন্ডনে টাকা এনে সেখান থেকে ঋণ নেন।
বিদেশে সম্পদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানান ব্যবসা থেকে আয় এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সেগুলো কিনছেন বলে দেখিয়েছেন সাইফুজ্জামান। দুবাইয়ে ব্যবসার মাধ্যমে করা আয় যুক্তরাজ্যে নিয়ে সম্পদ কিনছেন, এমনটি দেখানো হলেও বাংলাদেশ থেকেই দুবাইয়ে অর্থপাচার করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে।
এসব সম্পদের কোনো কিছুই সাইফুজ্জামান বাংলাদেশে তার বার্ষিক আয়কর রিটার্ন বা নির্বাচনী হলফনামায় কখনোই উল্লেখ করেননি।
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের এজেন্ট রিপন মাহমুদ আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জানান, এসব বিনিয়োগ হয় ছোট ছোট অংকে, যাতে সেসব দেশের সরকারের নজরে না পরে যায়।
রিপন বলেন, ‘তিনি (সাইফুজ্জামান) এক কোটি (ডলার) আনেন এবং বলেন যে আমি নগদে কিনিনি, ব্যাংক আমাকে টাকা দিয়েছে।’
কেবল যুক্তরাজ্যে নয় যুক্তরাষ্ট্রেও নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আছে সাইফুজ্জামানের। এর মধ্যে পাঁচটি নিউইয়র্কের প্রধান এলাকাগুলোতে এবং চারটি নিউজার্সিতে।
আলজাজিরাকে রিপন জানিয়েছেন, প্রতি বছর তার মাধ্যমে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন সাইফুজ্জামান। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এসব অর্থপাচার এবং বিদেশে বিনিয়োগের জন্য সেসব দেশের ব্যাংক কর্মকর্তা, ফাইন্যান্সার, আইনজীবী, রিয়েল স্টেট কোম্পানি, এজেন্টের সঙ্গে নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন সাইফুজ্জামান।
সাইফুজ্জামান আল-জাজিরাকে জানান, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আমেরিকায় তার বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত আয় দিয়েই এই সম্পত্তিগুলো কেনা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী আরও দাবি করেন, তিনি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।