সরকারের নির্ধারিত দামে মিলছে না চিনি

ডলারের উচ্চমূল্য ও আমদানি খরচ
বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ চিনির বাজারে সক্রিয় রয়েছে সিন্ডিকেট। চিনি সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও পণ্যটির বাজার বেশ চড়া। সরকারের পক্ষ থেকে চিনির বাজার দর নির্ধারণ করে দিলেও তদারকি না থাকায় ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা।
গতকাল মঙ্গলবার খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ (৩৭.২৩৭ কেজি) ৫ হাজার ৫০ থেকে ৫ হাজার ১৫০ টাকা দরে। একসপ্তাহ আগেও চিনি বিক্রি হয়েছিল প্রতি মণ ৪ হাজার ৭০০ থেকে ৪ হাজার ৮০০ টাকা। এতে প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সে হিসেবে কেজিপ্রতি চিনির দর পড়েছে ১৩৫ থেকে ১৩৮ টাকা। আর তা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। অথচ সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৩০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকা। সরকারি তথ্যমতে, একবছরের ব্যবধানে এ পণ্যটির দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি।
এদিকে সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করে দিলেও আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা মোটেও তোয়াক্কা করছে না। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি অভিযান পরিচালিত হলেও তা কাজে আসছে না। এমনকি সরকারের নির্ধারিত দরে পাইকারি আড়তেও মিলছে না চিনি।
বড় ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি কমিশন এজেন্ট ও খুচরা ব্যবসায়ীরা
খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাতুনগঞ্জে বড় ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই দর বাড়িয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন মধ্যস্বত্বকারবারিরা।
খুচরা ব্যবসায়ী আলী আহমদ সওদাগর বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের হাতে আমরা অনেকটা জিম্মি। যে দরে আমরা চিনি কিনি তা থেকে কিছুটা লাভে বিক্রি করতে হয়।
চিনির কমিশন এজেন্ট সাবের চৌধুরী বলেন, আড়তদাররা যে দর নির্ধারণ করে দেয় আমরা সে দরে চিনি বিক্রি করি। এসব বিষয় জানে পাইকার ও আড়তদাররা।
কলকাঠি নাড়ে বড় ব্যবসায়ীরা
জানা যায়, চিনি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। যাদের কাছে জিম্মি স্থানীয় কমিশন এজেন্ট, ব্যবসায়ীসহ পাইকাররা। তাছাড়া এসব চিনি মূল কারখানা থেকে আসতে সাত থেকে আট হাত বদল হয়ে পাইকারি বাজারে পৌঁছায়। যারা বাজারে প্রকাশ্যে না এলেও আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ে। তবে চিনির চড়া দরের বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারদের দায়ী করলেও তা পাইকাররা দায়ী করছেন মধ্যস্বত্বকারবারি ও বড় ব্যবসায়ীদের।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিনির দর নির্ধারণ করে দেয় মধ্যস্বত্বকারবারি ও আড়তদাররা। ফলে বাজারে সরকারের নির্ধারিত দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
খাতুনগঞ্জের এক চিনি ব্যবসায়ী বলেন, আমরা মধ্যস্বত্ব কারবারিদের থেকে চিনি আনি। তারা চিনির দর নির্ধারণ করে দেয়। এছাড়া চিনি আড়ত থেকে কিনলে আমাদের রশিদও দেয় না। এমনকি এক ট্রাক চিনি নিলেও রশিদ দেয় না।
ডলারের উচ্চমূল্য ও আমদানি খরচ বৃদ্ধি
অন্যদিকে বারবার চিনির বাজারে অস্থিরতাকে মধ্যস্বত্বকারবারিরা দায়ী করছেন ডলারের উচ্চমূল্য ও আমদানি খরচ বৃদ্ধিকে।
চিনি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত এক মধ্যস্বত্বকারবারি সুপ্রভাতকে বলেন, ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে চিনির আমদানি খরচ বেড়েছে। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতি কেজির দাম ১৪৮ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এর কোন সিদ্ধান্ত না আসলেও আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্ধারিত ওই দরে চিনি বিক্রি করতে পারছে না।
জানতে চাইলে চিনি ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য বলেন, সরকার চিনির বাজারের দর নির্ধারণ করে দিলেও বাড়তি ডলারের দাম ও এলসি খরচ। প্রতি কেজি চিনিতে ৪২ টাকার মতো ট্যাক্স দিতে হয়। যার কারণে এর প্রভাব পড়ছে আমদানিতে।
খাতুনগঞ্জে রাতারাতি বাড়ে চিনির বাজার
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ব্যবসার প্রচলন রয়েছে। কোনো পণ্যের লেনদেন ছাড়াই একটি ডিও কয়েক দফা হাতবদল হয়। যতবার হাতবদল হয় ততবার ডিও বা পণ্যের দাম বেড়ে যায়। চিনি কিংবা অন্য কোনো পণ্য কেনাবেচায় ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে বিভিন্ন আগাম লেনদেন হচ্ছে। যার ফলে চিনির বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। একাধিক হাতবদলের মধ্যেই কয়েক রাতারাতি বাড়ছে চিনির বাজার।
উল্লেখ্য, দেশে প্রতিবছর চিনি আমদানি হয় ২০ থেকে ২২ লাখ টন। অন্যদিকে, স্থানীয় উৎপাদন ৩০ হাজার টনের মতো, যা মোট চাহিদার ১ শতাংশের কিছুটা বেশি। ফলে চিনির বাজার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।