সমসাময়িক জ্বর এবং ফিজিওথেরাপির প্রয়োজনীয়তা

মো. খলিলুর রহমান »

সমসাময়িক ভাইরাল জ্বর, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। ডেঙ্গুতে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হওযার ঝুঁকিতে রযেছে। চিকুনগুনিযার বিশ্বব্যাপী প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে। সমানভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৪৩,৮৪১ জন আক্রান্ত ও ১৮৭ জন মারা গেছেন, যেখানে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। চিকুনগুনিয়াতেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং জুলাই মাসের পর থেকে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পেযেছে।
ভাইরাল জ্বর, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এই তিনটির মধ্যে মূল পার্থক্য হলো এদের লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসার ভিন্নতা। তবে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। মশাকে সাধারণত তিনটি প্রধান প্রজাতিতে ভাগ করা যায়: অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স এবং এডিস। এই এডিস মশার কারনে প্রাথমিক পর্যাযে, এদের উপসর্গ কিছুটা একই রকম হওযায চিকিৎসকদের জন্য রোগ নির্ণয় করা কঠিন হযে পড়ে। চিকিৎসা অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ বা শক হতে পারে যা চিকুনগুনিযায হয না, যেখানে চিকুনগুনিযার প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্টের ব্যথা।
ভাইরাল জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর ও চিকুনগুনিয়া জ্বরের পার্থক্য
সাধারণ ভাইরাল জ্বও ঃ-
কারণ: বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ
বাহক: কোনো নির্দিষ্ট বাহক নেই
প্রধান লক্ষণ : জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা
গুরুতর লক্ষণ: সাধারণত কম থাকে
গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য : এটি একটি সাধারণ উপসর্গ, যার কারণ ভিন্ন হতে পারে।
চিকিৎসা: উপসর্গ অনুযাযী চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরঃ-
কারণ: ডেঙ্গু ভাইরাস (৪টি সেরোটাইপ)
বাহক: এডিস মশার নির্দিষ্ট প্রজাতি
প্রধান লক্ষণ: জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা, ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব। গুরুতর লক্ষণ: রক্তপাত, শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি শরীর ঠান্ডা হযে নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, প্রেসার কমে যায় এবং রোগী জ্ঞান হারাতে পারে, যা ‘ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম’ হিসেবে পরিচিত। গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য: হেমোরেজিক (রক্তক্ষরণ) জ্বর এবং শক হতে পারে, যা প্রাণঘাতী। চিকিৎসা: উপসর্গ অনুযাযী এবং রক্তচাপ ও প্লেটলেটের দিকে নজর রাখা।
চিকুনগুনিয়াঃ-
কারণ: চিকুনগুনিযা ভাইরাস
বাহক: এডিস মশার নির্দিষ্ট প্রজাতি
প্রধান লক্ষণ: জ্বর, জয়েন্টে তীব্র ব্যথা, জয়েন্ট ফুলে যাওয্য, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, ফুসকুডি। গুরুতর লক্ষণ: জয়েন্টের ব্যথা দীর্ঘস্থাযী হতে পারে, যা কযেক মাস বা বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য: জয়েন্টের ব্যথা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং দীর্ঘস্থাযী হতে পারে। চিকিৎসা: উপসর্গ অনুযাযী চিকিৎসা, কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
ভাইরাল জ্বর, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে মিল থাকায় এ সময় কালবিলম্ব করা যাবে না। তাই যদি আপনার তীব্র জ্বর, জয়েন্টে তীব্র ব্যথা, অস্বাভাবিক রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট, বা অন্য কোনো গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কখন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যাবেন?
একটু অবাক হলেও জ্বরের ধরন ও সময়ের উপর ভিত্তি করে ফিজিওথেরাপি পরোক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে, কারণ এই রোগগুলোর ফলে শরীর ব্যথা, দুর্বলতা ও জয়েন্ট শক্ত হযে যায। ফিজিওথেরাপি শারীরিক কার্যকারিতা বাড়াতে এবং আক্রান্ত অংশের নড়াচড়ার ক্ষমতা ফিরিযে আনতে সাহায্য করে, যা রোগীদের দ্রুত সুস্থ হতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহাযতা করে।
ফিজিওথেরাপির প্রযোজনীযতা
কর্মক্ষমতা পুনরুদ্ধার:
যখন শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতা হয়, তখন ফিজিওথেরাপি আক্রান্ত মাংসপেশি ও জয়েন্টের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।

ব্যথা ও নড়াচড়ার সমস্যা:
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিযার মতো রোগে আক্রান্ত হলে শরীর ম্যাজম্যাজ করা বা জয়েন্ট শক্ত হওযার সমস্যা হতে পারে, যা ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে কমিযে আনা যায।
কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি :
ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে শরীরের নড়াচড়ার ক্ষমতা বাড়ে এবং স্বাভাবিক কার্যকলাপে ফিরে আসা সহজ হয়।
শ্বাসকষ্ট প্রতিহত করা ঃ
ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে শ্বাসকষ্ট প্রতিহত ও শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়।
ঝুঁকি হ্রাস :
ফিজিওথেরাপি রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং দীর্ঘমেযাদী শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধ করতে সহায়ক।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা (সাধারণ নীতি/ প্রিন্সিপাল)
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াজনিত ভাইরাল জ্বরের জন্য ডঐঙ এর ২০২৫ সালের নির্দেশিকায় সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে ফিজিওথেরাপি সেবার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায় (তীব্র পর্যায়):
বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: পরিশ্রম এবং কঠোর কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা।
মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধির ব্যথা ব্যবস্থাপনা : ঠান্ডা সেক ও থেরাপিউটিক মোডালিটিস মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধির ব্যথা এবং ক্ষতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
পর্যাপ্ত পানি বা তরল গ্রহণ : ইলেক্ট্রোলাইটযুক্ত প্রচুর তরল যেমন ডাবের পানি, শরবত পান করা, স্যুপ বা তরল খাবার গ্রহণ করা। তবে রক্তচাপ, কিডনি বা অন্য জটিলতা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
রোগ নিরাময়ের পর্যায়:
ক্রমান্বয়ে ব্যায়াম নির্ধারণ ও বৃদ্ধি : একজন সার্টিফাইড ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে আক্রান্তের ধরণ অনুসারে গতি এবং কার্যকারিতা উন্নত করার জন্য ধীরে ধীরে হালকা, মৃদু ব্যায্যম চালু করা।
মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধি জমে যাওয়া প্রতিরোধ করা : চিকুনগুনিযার একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হতে পারে মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধি জমে যাওয়া, তাই মোকাবেলা করার জন্য ব্যায়ামগুলিতে মনোনিবেশ করা।
রোগীকে সচেতন ও অবহিতকরণ : রোগীদের শক্তি সংরক্ষণ এবং লক্ষণগুলি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন তা সম্পর্কে শিক্ষিত করা যাতে তাদের অবস্থা আরও খারাপ না হয।

গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়:

ব্যথানাশক এড়িয়ে চলুন : জটিলতা প্রতিরোধের জন্য ডেঙ্গুর প্রাথমিক পর্যাযে (প্রথম ১০ দিন) ব্যথানাশক বা রক্ত পাতলা করার ঔষুধ এড়িয়ে চলা উচিত। বাজারে যা ব্যথা বা মাথা ব্যথার বড়ি বলে প্রচলিত। চিকিৎসকের মাধ্যমে ডেঙ্গু নয় নিশ্চিত হবার পরেই চিকুনগুনিয়ায় ব্যথানাশক ঔষুধ বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ একটু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ প্রাণনাশ।
তাপ এড়িয়ে চলুন : তীব্র পর্যাযে তাপ এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধির ব্যথাকে আরও খারাপ করতে পারে।
সমন্বিত পদক্ষেপ : মূলত সকল নির্দেশিকাগুলিতেই সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেনতা বৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো শক্তিশালীকরণের গুরুত্বের উপর জোর দেয়া।
সর্বশেষ এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের জন্য ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে চিকুনগুনিয়ার তীব্র জয়েন্টে ব্যথা এবং ডেঙ্গু থেকে সৃষ্ট শারীরিক দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট ও পেশী ব্যথার ক্ষেত্রে। এমতাবস্থায় জটিলতা ও ক্ষতি এড়াতে সার্টিফাইড বা বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট এর নিকট থেকে সেবা নেয়া অধিক নিরাপদ।

লেখক : কনসালটেন্ট-ফিজিওথেরাপি ও কেন্দ্র ব্যবস্থাপক