মাছুম আহমেদ »
‘আমার’ ও ‘তোমার’ ( মাইন অ্যান্ড থাইন) উপলব্দির মধ্যদিয়েই ব্যক্তি স্বার্থের সূচনা। এ ধারণাই মানুষের সঙ্গে মানুষের সংঘাত তৈরি করেছে। সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা থমাস হবসের বিখ্যাত লেভিয়াথান এ আমরা সেই সংঘাতের স্পষ্ট চিত্র দেখতে পাই। গ্রন্থটিতে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ কীভাবে স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে একটি অস্থির সমাজে অবতীর্ণ হয়। মূলত বৈষয়িক বিষয়াদি যথা জায়গা-জমি, ফল-ফসল আর দৈনন্দিন জীবনের ভোগবিলাসের উপকরণই মানুষকে স্বার্থের সংঘাতের পথে আহবান করে।
হবস প্রবর্তিত ধারণায় আমরা দেখতে পাই, সামাজিক রাষ্ট্রে অর্থাৎ তথাকথিত সভ্য সমাজে প্রবেশের আগে প্রাকৃতিক রাজ্যে মানুষ নিজেদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে রীতিমত ‘যুদ্ধরাষ্ট্রে’ নিপতিত হয়। সেখানে প্রত্যেকের সঙ্গেই যেন প্রত্যেকে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। সমাজকে দেখভাল করার মত সামাজিক অভিভাবক, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় হবসীয় প্রাকৃতিক রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল। যাদের পেশিশক্তি ছিল তারা হয়ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য নিজের অধীনে রেখে বীরত্বের ভূমিকায় ছিলো বটে, তবে তাতে তাদের স্বস্তি-শান্তি ছিল না। কারণ বাহুবলে পিছিয়ে থাকা অভুক্ত ও বঞ্চিতরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে খাদ্য ছিনিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজত। এতে করে মজুদকারীর সম্পদ তাদের নিজের জীবনকেই অনিরাপদ করে তুলেছিল।
আধুনিক সমাজে সম্পদশালীরা বাড়িতে, গাড়িতে পাহারাদার বসিয়ে, লকারে সম্পদ বন্দি করে কিংবা সদর দরজায় প্রশিক্ষিত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। হবসীয় প্রাকৃতিক রাষ্ট্রে সেই অবকাশ না থাকায় সম্পদ রক্ষায় মল্লযুদ্ধে জীবনহানি ছিল নিত্যঘটনা। এখানে আমরা স্পষ্ট টের পাই সম্পদই মানুষকে সংঘাতে আমন্ত্রণ জানায়, আবার সেই সম্পদই মানুষের জীবনকে সবচেয়ে অনিরাপদ করে তোলে।
হবসীয় প্রাকৃতিক রাজ্যের মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা আর শান্তির জন্য সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে শাসিত হওয়ার উদ্যোগ নিল। শাসন ও শাসিতের এ সমাজকে বলা হলো ‘সভ্য সমাজ’ তথা ‘সিভিল স্টেট’। ‘যুদ্ধরাষ্ট্র’ এর মানুষ শুধু নিরাপত্তা আর শৃঙ্খলার স্বার্থে নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকেও কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করতে কোনো দ্বিধা করলো না।
এবার পরিস্থিতি পাল্টালো বটে, কিন্তু ভিন্ন সমস্যার আশংকা তৈরি হলো। একক আধিপত্য পেয়ে হবসীয় সভ্য রাষ্ট্রের শাসকের ‘রাষ্ট্রদানব’ (লেভিয়ান) হয়ে ওঠার উপক্রম হলো। জনগণ সেখানে শাসকের হাতের পুতুল। পরম ক্ষমতা হয় কাউকে ‘ঈশ^র’ বানায় অথবা সেই ক্ষমতায় কেউ অবতীর্ণ হয় দানবে। সভ্যতার ইতিহাসে তাকালে আমরা এর বহু উদাহরণ খুঁজে পাব। একারণেই হয়ত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য ‘দার্শনিক রাজা’ চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছেন, প্রজ্ঞাবান মানুষ জ্ঞানকে নিজের শক্তি-সম্পদ মনে করে; পক্ষান্তরে অন্যরা বৈষয়িক সম্পদকে মনে করে ক্ষমতা ও শক্তি। যুক্তিবোধ দ্বারা পরিচালিত মানুষ অন্যায়ের পথ বেছে নিতে পারে না। তাই, রাষ্ট্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য চাই ন্যায়বান শাসক। প্লেটোর মতে, দার্শনিক তথা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিই তাই শাসক হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত। একই কারণেই হয়ত বলা হয়ে থাকে, ‘একটি সমাজের একশ বুদ্ধিজীবীর মৃত্যু হলেও যতটা না ক্ষতি হয় তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যদি একজন মূর্খ শাসক সেই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় চেপে বসে।’
যাইহোক হবসীয় সভ্য সমাজে শাসক হিসেবে ‘দানব’ যাতে চেপে না বসে সেই পথ রুদ্ধ করতে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লক বললেন, ‘ক্ষমতাকে ক্ষমতা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে’। পরাক্রমশালী সরকার যাতে সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করে সেজন্য চাই শক্তিশালী বিরোধী দল। বড় ঢেউ মোকাবেলার জন্য চাই মজবুত বাঁধ। একইভাবে শাসকের ক্ষমতার উৎস যদি হয় জনগণ তাহলে সেই শাসকের জনবিরোধী হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা জনতার শক্তির কাছে তার ক্ষমতা সহজেই পরাস্ত হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
লক জনগণকে ক্ষমতাবান করতে চাইলেন। লকীয় প্রাকৃতিক রাজ্যের মানুষও তাই নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা আর সম্পত্তির নিরাপত্তার শর্তে শাসক নির্বাচন করে সভ্য সমাজে প্রবেশ করলো। তবে ‘শ্রম যার সম্পদ তার’- লকের এমন নীতির রাষ্ট্রে পুঁজিবাদ লাগামহীন হওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। ধনী ও দরিদ্র শ্রেণি তৈরির অফুরন্ত পথ খুলল। সম্পদের মানদ-ে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বিকাশের পথ মসৃণ হলো। সম্পদের তারতম্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো দুই শ্রেণির মানসিক দূরত্ব। মধ্যবিত্তের দুকূলই গেল। না তারা বিত্তের আশ্রয় পেল, না পেল গরিবের আনুকূল্য। ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষমতা রাষ্ট্রক্ষমতার পাহারাদারের ভূমিকা উৎরিয়ে সেই রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের পথে সচ্ছন্দ হলো। ক্ষমতার স্বাদ ও গন্ধে সুবাস ঢালতে লাগলো দুর্নীতি। বাড়লো অপরাধ। বাড়লো পুলিশি ব্যবস্থা। বাড়লো আদালতের ব্যাপ্তিও। সম্পত্তি নিয়ে সংঘাতে ঘরে ঘরে সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতার সমান্তরালে মামলার স্তূপ জমতে লাগলো আদালতে। আবার যেন সেই যুদ্ধরাষ্ট্র!
এখন তাহলে কীভাবে সমাধান? রাষ্ট্র দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশো আশার আলো দেখালেন। প্রথমেই জীবন-বিনাশী ও সম্পর্ক-বিধ্বংসী ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে তুলে দিয়ে ‘কমনওয়েলথ’ এর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন তিনি। সম্পত্তি মালিকানা কেবল রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সবার, তাই রাষ্ট্রের সম্পত্তিও সকলের। সেখানে সব নাগরিকের সমান মালিকানা। জায়গা-জমি নিয়ে সহিংসতা, অপরাধ ও মামলা-মোকাদ্দমা বন্ধ!
রুশো এখানেই শেষ করেননি; রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সর্বজনীন করলেন। উপস্থাপন করলেন ‘সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব’, যেখানে সবার মতামতের সমান গুরুত্ব ও সমান মর্যাদা। ক্ষমতার মালিক যৌথভাবে প্রত্যেকে। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিলেন সামষ্টিক স্বার্থকে। এক ধরনের আত্ম-উৎসর্গের উদ্দীপনা সজীব হলো। বিষয়টি এমন, ‘ক’ দেখবে ‘খ’ এর স্বার্থ এবং একইভাবে ‘খ’ দেখবে ‘ক’ এর স্বার্থ। এতে ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাতও থাকবে না আবার পরস্পরের স্বার্থও সংরক্ষিত হবে, উইন-উইন সিচুয়েশন। একটি ভালোবাসাময় সমাজ (লাভিং সোসাইটি)! পরস্পরের স্বার্থ দেখলেই কেবল একটি টেকসই নিরাপত্তা সম্ভব বলে এ ব্যবস্থায় প্রতীয়মান হয়। সেখানে কাউকে অনিরাপদ রেখে সবার নিরাপত্তা সম্ভব নয়। প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলেই কেবল সবাই নিরাপদ হবে, অন্যথায় নয়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেই কথাটিই বিশ^ দরবারে উপস্থাপন করেছেন। কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে তিনি সেই লাভিং সোসাইটির পথেই সবাইকে আহবান করলেন। গত ১০ নভেম্বর জাতিসংঘের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেন সরকার আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি রুশোর রাষ্ট্রদর্শনকেই যেন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়। এজন্য বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কার্বন নির্গমণ হ্রাস করে আমাদের গ্রহকে সুরক্ষিত করতে হবে এবং আমাদের বহুপাক্ষিক প্রয়াসকে আরো জোরদার করতে হবে।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট, কানাডার প্রধানমন্ত্রী, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ও জর্ডানের উপ প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ^ নেতারা সেই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন (সুপ্রভাত, ১১ নভেম্বর)।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, “বিশ^ায়নের এই যুগে কার্যকর বহুপাক্ষিতার বিকল্প নেই। মানবজাতির অভিন্ন অগ্রগতি এবং ন্যায়ভিত্তিক আন্তর্জাতিক নির্দেশনার এটিই একমাত্র পথ।”
প্রধানমন্ত্রী কোভিড ১৯ মহামারি থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, ইতিহাস প্রমাণ করে যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা থেকে যে কোনো বিচ্যুতি মানবজাতির জন্য বিপর্যয় নিয়ে আসবে।” বিশে^ শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকতে তিনি সবার প্রতি আহবান জানান।
করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে বর্তমানে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অবতারণা হয়েছে সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য একটি সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার টিকা-দৌড়ে অনেকদূর এগিয়েছে বটে, কিন্তু বিশে^র কোনো জনপদকে অনিরাপদ রেখে সেই সুরক্ষা যে কল্পনা-বিলাস, ভাইরাসের বিস্তারণ ও সংক্রমণ থেকে সেটি আমরা গভীরভাবে অবলোকন করি। ভৌগোলিক বিভাজনের দেয়াল যদি সুরক্ষা কবচ হতো তাহলে চীন থেকে ভাইরাসের বিশ^ায়ন হতো না। সুতরাং, ধনী-গরিব সব রাষ্ট্রের মানুষকে সমান গুরুত্ব দিয়েই সর্বজনীন নিরাপত্তা একমাত্র বিকল্প। ভালোবাসায় মেলে ভালোবাসা, ঘৃণায় নয়। পরস্পরের স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যমেই কেবল বিশ^নিরাপত্তা ও বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ^নেতা হিসেবে সেই দর্শনই উপস্থাপন করেছেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়