আগামী মাসে বরাদ্দগ্রহীতাদের বুঝিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ#
দুই বছরে বন্দর রাজস্ব হারালো ৪০ কোটি টাকা #
ভূঁইয়া নজরুল :
অবশেষে সচল হচ্ছে সদরঘাট এলাকার ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে চার লাইটার (ছোটো জাহাজ) জেটি!
২০১৮ সালের মে মাসে দেশের নামকরা কিছু শিল্পগ্রুপের কাছে এসব লাইটার জেটি বরাদ্দ দেয়া হলেও ড্রেজিং জটিলতায় গত ২৬ মাসে এগুলো বুঝিয়ে দিতে পারেনি। এসব জেটি থেকে প্রতিবছর প্রায় ২০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। সেই হিসেবে গত দুই বছরে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে স্বায়ত্বশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি। আগামী জুলাই মাসে নতুন অর্থবছর থেকে বরাদ্দ পাওয়া চার শিল্পগ্রুপকে চারটি জেটি বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
আগামী মাসেই বরাদ্দপ্রাপ্তদের মাঝে জেটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রোববার পরীক্ষামূলকভাবে একটি জাহাজ ভিড়ানো হয়েছে বলে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার ও সদরঘাট থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত ড্রেজিং এর মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আজ (রোববার) দুটি জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে টেস্ট করেছি, কাল (সোমবার) আরো দুটি জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর কাজ করবো। আর এতে সফল হলে আগামী মাসে নতুন অর্থবছর থেকে বরাদ্দগ্রহীতারা এসব জেটি ব্যবহার করতে পারবে।’
যে জাহাজটি ভেড়ানো হয়েছে এর দৈর্ঘ্য কত ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ও পানগাঁও রুটে চলাচলকারী ৭২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ দশমিক ৬ মিটার ড্রাফটের একটি জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে। তবে জেটিতে মাইনাস ৪ দশমিক ১ মিটার ড্রাফট রয়েছে। বিধি অনুযায়ী মাইনাস চার মিটার ড্রাফট থাকার কথা।
তিনি বলেন, এখানে ড্রেজিং করতে দেশের সবচেয়ে Ÿড় কাটার সাকশান ড্রেজারও এনেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু পলিথিন ও আবর্জনার কারণে কাটার সাকশান ড্রেজার ব্যর্থ হওয়ার পর সনাতন পদ্ধতিতে (গ্র্যাব ড্রেজার- উভয়পাশ থেকে চিমটি দিয়ে নিচ থেকে আবর্জনা তুলে আনা) এসব আবর্জনা তুলে জেটির ড্রাফট বাড়ানো হয়েছে। এতে কর্ণফুলী নদী থেকে সহজে লাইটার জাহাজগুলো পণ্য নিয়ে জেটিতে ভিড়তে পারবে।
২০১৩ সালে কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় ৪০০ মিটার দীর্ঘ জেটি নির্মাণ হয়েছিল। পরবর্তীতে আইনি ঝামেলায় ড্রেজিং প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবার পর ২০১৭ সালে সরাসরি সংগ্রহ পদ্ধতিতে (ডিপিএম) কর্ণফুলী ড্রেজিং কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২৫৮ কোটি টাকায় ‘কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত ড্রেজিং এর মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি’ প্রকল্পের অধীনে ডিপিএম পদ্ধতিতে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নৌ কল্যাণ সংস্থাকে দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ড্রেজিংয়ের কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যই এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের ৫ মে। কিন্তু নৌ কল্যাণ সংস্থা ড্রেজিংয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর তা সাব ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয় বন্দর পরিচালনায় অন্যতম কোম্পানি সাইফ পাওয়ার টেকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ই ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ই ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড চীন থেকে দেশে ব্যবহৃত ড্রেজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাটার সাকশান ড্রেজারটি আনলেও তা এখানে কাজে লাগাতে। এবিষয়ে সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন তরফদার বলেন, ‘পলিথিন জটিলতা ও আবর্জনার কারণে আমরা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ড্রেজার এনেও কাজ করতে পারিনি। অবশেষে গ্র্যাব ড্রেজার ব্যবহার করে লাইটার জেটির সামনের অংশের ড্রেজিং সম্পন্ন করেছি। আজ (রোববার) পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ ভিড়লো।’
এদিকে চারটার লাইটার জেটির একটির বরাদ্দ পাওয়া দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন,‘ লাইটার জেটি প্রস্তুত হওয়ার বিষয়টি এখনো আমরা অবগত নই। সি লেভেল ( সমুদ্র সমতল) থেকে মাইনাস চার মিটার ড্রাফট আছে কিনা, সংযোগ রাস্তাগুলো সঠিকভাবে রয়েছে কিনা এবং সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়ার উপর নির্ভর করছে ইয়ার্ড বুঝে নেয়ার বিষয়।‘
একইভাবে খাদ্যশস্যবাহী পণ্যের জন্য বরাদ্দ পাওয়া বিএসএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘অনেক আগে বরাদ্দ দিলেও বন্দরের পক্ষ থেকে এখনো তা আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারেনি। এখন যেহেতু পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ ভেড়াচ্ছে তাই অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সবকিছু ঠিক আছে কিনা তা চেক করে দেখতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, পণ্যবাহী ট্রাকগুলো কোন রুট দিয়ে প্রবেশ ও বের হয়ে আসবেও সেগুলোও নির্ধারণ হতে হবে।
বরাদ্দপ্রাপ্ত অন্যান্য শিল্পগ্রুপের প্রতিনিধিরা জানান, আমরা যেদিন থেকে বুঝে নিবো সেদিন থেকেই বন্দর মাশুল গুণবে। সবকিছু ঠিকমতো রয়েছে কিনা তা যাচাই করা হবে। একইসাথে বুঝিয়ে দেয়ার পর আগামী এক বছরের মেইনটেনেন্স ড্রেজিংও বন্দর কর্তৃপক্ষ করার কথা।
দুই বছরে বন্দর রাজস্ব হারালো ৪০ কোটি টাকা
পাঁচ লাইটার জেটি ছয় মাসের মধ্যে সচল করে দেয়া হবে এই লক্ষ্যে ২০১৮ সালের মে মাসে খাদ্যশস্যের জন্য বিএসএম গ্রুপ, লৌহ ও ইস্পাত খাতে বিএসআরএম, কেএসআরএম ও আবুল খায়েরকে এবং সিমেন্ট শিল্পে কনফিডেন্সকে দরপত্রের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি জেটির বিপরীতে ভ্যাটসহ গড়ে ৫ কোটি টাকা করে বন্দর পাওয়ার কথা। এরমধ্যে মাত্র একটি জেটি কনফিডেন্স সিমেন্টকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। যেটি বুঝিয়ে দিয়েছে সেটা ৪০০ মিটার দীর্ঘ লাইটার জেটি থেকে পৃথক স্থানে রয়েছে। ৪০০ মিটার দীর্ঘ জেটি এলাকায় চারটি জেটি রয়েছে। সেগুলো এখনো বরাদ্দ পাওয়া শিল্পগ্রুপগুলোকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি। এতে গত দুই বছরে বন্দর রাজস্ব হারিয়েছে ৪০ কোটি টাকা।
কেন এতোদিন পারেনি?
কর্ণফুলী নদী ড্রেজিংয়ের জন্য চায়না থেকে দেশে ব্যবহারযোগ্য সবচেয়ে বড় কাটার সাকশান ড্রেজার ( ৩১ ইঞ্চি ব্যাস) আনা হয়েছিল। কিন্তু বিশাল এই কাটার সাকশান ড্রেজার দুই দিন চলার পর তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৬ মিটার গভীর পর্যন্ত পলিথিন, চালের বস্তা কিংবা পাথর থাকায় তা ব্যবহার করা যায়নি। পরবর্তীতে ড্রেজারটি চীনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কাটার সাকশান ড্রেজার কাজ করতে পারেনি বলে বাংলা পদ্ধতি (সনাতন পদ্ধতি) ব্যবহার করে গ্র্যাব ড্রেজার দিয়ে ময়লা আবর্জনা শুরু করা হয়।
উল্লেখ্য, ২৫৮ কোটি টাকায় কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় প্রায় চার কিলোমিটার নাব্যতা বৃদ্ধি, সদরঘাটের চারটি লাইটার জেটি ভেড়ানোর উপযোগী ড্রেজিং করা, আটটি খালের মুখ পরিষ্কার করা, ড্রেজিংয়ের মাটি নাজির চরে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজ ছিল।