হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু’র জন্যই সকল প্রশংসা, যিনি তাঁর অসংখ্য সৃষ্ট প্রাণিদের মাঝে বহুবিধ প্রশংসনীয় গুণাবলী নিহিত রেখেছেন। আর এদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও বিচরণের যথোপযুক্ত ক্ষেত্র রেখেছেন। তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করি, যিনি তাঁর অবতীর্ণ পবিত্র গ্রন্থ স্পর্শের জন্য পবিত্রতার শর্ত আরোপ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি আমাদেরকে তাঁর একক সত্তা ও সামগ্রিক গুণাবলীর প্রতি ঈমান আনার তাওফীক দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ্র একত্বের জয়গান করি। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নেই। আমাদের রাহ্বার, কর্ণধার, শাফাআতের তাজদার, সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও শ্রেষ্ঠতম রাসূল। যিনি চির সত্যের ধারকÑবাহক।
বরকতময় মহান সত্তা তিনি, সমগ্র রাজত্ব যাঁর কুদরতের কব্জায়। প্রত্যেক বস্তুর ওপর যিনি ক্ষমতাবান। অর্থাৎ ছোটবড় কোন কিছুই তাঁর কুদরতের বলয়চ্যুত নয়। সবকিছুর মত তিনি আমাদের হায়াতÑমাওত তথা জীবনÑমৃত্যুও সৃষ্টি করেছেন। বুদ্ধি হওয়ার পূর্বেকার এবং মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাবলী বিস্মৃতি ও ক্ষমতাবহির্ভূত হওয়ায় বর্ণনারও বাইরে। আমাদের জন্মপূর্ব এবং মরণোত্তর অনেক কিছু ঘটেছিল এবং ঘটবে। আমাদের সামনে অনেকেই যেমন জন্মগ্রহণ করছে, তেমনি অনেকেই মৃত্যুও বরণ করছে। জন্ম ও মৃত্যুর ফ্রেমেই আমাদের জীবনকাল স্থিতি পায়। এ মৃত্যুর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যই প্রাণির জীবন। জীবনের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী নয়; তবে জীবন থাকলে কিন্তু মৃত্যুর আগমন অবশ্যম্ভাবী। পবিত্র কুরআনের একাধিক স্থানে উল্লেখ আছে জীবনের অপরিহার্য পরিণতির কথা, ‘কুল্লু নাফসিন যা ইকাতুল মাওত’। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
মাহে জুমাদাল উখরার আজ প্রথম জুমা’র দিন। দিন, রাত করে সপ্তাহ যায়। সপ্তাহ শেষে মাস। এভাবে বছর গড়ায়। এক সময় আর টেরই পাইনা যে, কখন জীবনের বেলা অস্তাচলে উপনীত। বরফের চাক যেমন নিজেই বুঝতে পারে না, গলতে গলতে কখন সে ফুরিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। আজকের খুৎবার আলোচ্য রূপে এসেছে মৃত্যুর প্রসঙ্গ। অনুষঙ্গ স্বরূপ সাকরাত বা মৃত্যুÑযন্ত্রণার কথা। মৃত্যুর পূর্বে সবাই আমরা ‘সাকরাত’ প্রত্যক্ষ করব। অবশ্য এটা আমরা প্রত্যক্ষ করব এমন সময়ে, যখন বর্ণনা দিতে পারব না পাশে বসা স্বজনকেও।
আমরা জানি, এ মাসেই ওয়াফাত বরণ করেন, নবীর পরেই যিনি শ্রেষ্ঠতম মানুষ, সায়্যিদুনা সিদ্দীকে আকবর, খলীফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর (রাদ্বি.)। হযরত আবু বকর (রাদ্বি.) শুধু ইসলাম গ্রহণে অগ্রণী ছিলেন, তাÑই নয়; বরং সর্বগুণেই তিনি সর্বাগ্রে ছিলেন। ঈমান গ্রহণের পরই মুসলমানের অন্যান্য ভালো বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনার জন্য ধর্তব্য হয়। মুমিন বান্দার জীবনাদর্শের জন্য খোদা প্রদত্ত মৌলিক জীবন বিধান হল পবিত্র কুরআন। যা দলীল চতুষ্টয়ের মধ্যে প্রধান। পবিত্র কুরআনের প্রারম্ভেই বর্ণিত, এটি হেদায়ত (বা পথনির্দেশনা) মুত্তাকী বান্দাদের জন্য। একটু অগ্রসর হলেই এ প্রসঙ্গের উপসংহারের ভঙ্গিতে বলা হয়েছে, ‘নিজ প্রভুর পক্ষ থেকে তাঁরা হেদায়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁরাই তো সফলকাম।’ যাঁদের কথা বলা হল, তাঁদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁরা অদৃশ্য বিষয়াদির ওপর ঈমান রাখেন, নামায কায়েম করেন এবং আল্লাহর সম্পদ থেকে ব্যয় করেন, তাছাড়া কুরআন ও এর পূর্বেকার আসমানী গ্রন্থ সমূহের প্রতি ঈমান আনেন। সর্বোপরি, তারা আখেরাতের প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করেন। বর্ণিত সব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান হল ঈমান। ঈমান’র মূলকথা ‘তাসদীক’ বা নবীজির আনা সমূহ বাণীকে অকাট্য ‘সত্য’ বলে জেনে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করে নেয়া।
‘তাসদীক’ শব্দটির অর্থ সত্যায়ন করা, সত্য বলে স্বীকার করা, মেনে নেয়া বা গ্রহণ করা। এখান থেকে হয় ‘মুসাদ্দিক’। অর্থ সত্যায়নকারী। খুৎবায় আলোচ্য আয়াতটিতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যিনি সত্য সহকারে আগমন করেছেন এবং যে ব্যক্তি বিষয়টিকে সত্য বলে গ্রহণ করেছে (বা যাঁরা তা সত্য জেনে মেনে নেবে) তাঁরাই তো মুত্তাকী (খোদাভীরু), তাঁদের জন্য নিজ পালনকর্তার কাছে তাÑই রয়েছে, যা তাঁরা প্রত্যাশা করেন। সেটাই সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান। (সুরা যুমার : আয়াতÑ৩৩)
মাওলা আলী শেরে খোদা (রাদ্বি.)র বর্ণনানুযায়ী এ আয়াতে সত্য সহকারে আগমনকারী হলেন আল্লাহ্র রাসূল, আর যিনি তা সত্য বলে মেনে নেন তিনি হলেন প্রথমত সিদ্দীকে আকবর হযরত আবু বকর (রাদ্বি.)। আয়াত লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয়, প্রথমোক্ত দু জনের প্রসঙ্গে এক বচন ব্যবহৃত হয়। তাই প্রাথমিক অবস্থা অনুযায়ী সত্য এনেছেন প্রিয়নবী, আর গ্রহণ করেছেন আবু বকর (রাদ্বি.)। এরপর পর্যায়ক্রমে সত্য গ্রহণকারী রূপে গণ্য হবে অকপটে ঈমান আনয়নকারী সবাই। কিয়ামত পর্যন্ত যাঁরা মুমিন হিসাবে পরিচিত হবেন তাঁরা সকলেই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ জন্য আয়াতের শেষাংশে দেখা যাচ্ছে, বহুবচনের প্রয়োগ। বলা হয়েছে, তাঁরাই মুত্তাকী, তাঁদের জন্য রয়েছে প্রত্যাশিত পুরস্কার। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শুরুটা হয়ে থাকে কোন একজন দিয়ে। ‘তিনি সত্যকে বরণ করলেন”-এ উক্তি থেকেও সেটাই প্রমাণিত হয়। তাই, প্রথম সত্যের আলোকে আলিঙ্গন করার সৌভাগ্য কারো না কারো হয়েছিল। সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, তিনি নবীজিরই সার্বক্ষণিক সহচর হযরত আবু বকর (রাদ্বি.)। হযরত ইমাম হাসান (রাদ্বি.)র বর্ণনায়, ‘আমার পিতা হযরত আলী (রাদ্বি.) বলেছেন, চারটি বিষয়ে হযরত আবু বকর (রাদ্বি.) আমার চেয়ে অগ্রগামী হন, ১. তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। ২. প্রথম প্রকাশ্যে নামায পড়েন। ৩. হিজরতের মত পুণ্যময় কাজে তিনি আমার আগেই অংশগ্রহণ করেন। আর ৪. হিজরতকালে রাসূলুল্লাহ্র একমাত্র সঙ্গী হিসাবে সাওর গুহায় অবস্থান করেন। যে সৌভাগ্য আমারও হয়নি। (তা’রীখুল খুলাফা)
এ আয়াতে সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.)র যে বিশেষণ উল্লেখ হয়েছে, তা আরেকটি আয়াতেও মহান আল্লাহ্ উল্লেখ করেছেন। তাও অভিন্ন শব্দেই। সুরা লাইলের সমগ্রটা তাঁরই প্রসঙ্গ চর্চা করেছে। তাঁর প্রসঙ্গ অধিকতর সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল করতে যুগপৎ বিপরীত সত্তার উল্লেখ রয়েছে বটে। মহান আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যিনি দান করেছেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছেন এবং যিনি সুন্দরতম বিষয়কেই সত্য বলে গ্রহণ করেছেন। অতঃপর এর বিনিময়ে আমি সহজ জীবনের জন্য তাঁর পথ চলাকে সহজতর করে দেবো’। এখানে ‘সহজ জীবন’ বলতে বেহেশতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশের জীবনকেই বুঝানো হয়েছে। আর এ দুনিয়াতে পথ সুগম হওয়া মানে, যা আল্লাহ্র বচনে ‘হুসনা’। তা হলো ইসলামে’র পথ। এ পথ তাঁর জন্য সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। তিনি যে কোন ত্যাগ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের জন্য সহাস্য বদনে, স্বচ্ছন্দে, আনন্দ ও আগ্রহ সহকারে অবলীলায়, সর্বাগ্রে করতে পারতেন। সেখানে তাঁর তুলনা তিনিই। তিনি এমন ‘সুন্দর জীবন চলা’ তথা নবীর সন্তুষ্টি বিধানে তাঁরই নিখুঁত নির্দেশনা পালনের জন্য উদগ্রীব থাকতেন। নবীজির পদাঙ্ক অনুসরণই তাঁর দৃষ্টিতে ‘সত্য’ হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি সেই সুন্দরতম’র অনুসরণে অতি সাবলীল ছিলেন। অন্তর্দৃষ্টিতে ‘সত্য’ স্বচ্ছ হয়ে ধরা পড়া পরম সৌভাগ্য। সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.)র জীবনেই যথাযথভাবে, সবার আগে প্রতিফলিত হয়েছে ‘সাদ্দাকা বিল হুসনা’-র স্বরূপ।
এ চাঁদের ৭ তারিখ তিনি অসুস্থ হন। যাঁরাই তাঁকে দেখতে এসেছিলেন সকলে একজন চিকিৎসক ডাকার পরামর্শ দিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ্ আমার প্রতি তাকিয়ে আছেন, তিনি বলছেন, আমার যেটা ইচ্ছা হয়, আমি সেটাই করি। আর তেলাওয়াত করলেন, আল্লাহ্র বাণী, ‘মৃত্যুর যন্ত্রণা বাস্তবিকই এসে গেল। তা হলো ওটাই, যা থেকে তুমি পলায়ন করতে’। আয়াত-১৯ সুরা ক্বাফ। দু’সপ্তাহ রোগভোগ শেষে ২২ জুমাদাল উখরা ১৩হি. তিনি ইন্তেকাল করে রাসূলুল্লাহ্র চির সান্নিধ্যে গমন করেন। ‘সাদ্দাকা’-ওয়ালা ‘জা-আ-বিস্ সিদ্ক’ ওয়ালার সাথে অন্তিম শয়নে মিলিত হন।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।