সচল হতে হতেই অচল

চমেক হাসপাতালে সিটি স্ক্যান সেবা

নিলা চাকমা »

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগে দু থেকে আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে সিটি স্ক্যান সেবা চালু হয়। তবে সচলের এক মাস না পেরুতেই ফের অচল সিটি স্ক্যান। এবার মেশিনটির ‘আর্থিং ক্যাবল’ চুরি যাওয়ায় টিউব নষ্ট হতে পারে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের। ফলে চলতি বছরে তৃতীয়বারের মতো সেবা বন্ধ হলো।

এ পরিস্থিতিতে সরকারি সেবা নিতে না পারায় গরিব রোগীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে প্রতিদিন সিটি স্ক্যান করতে এসে সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে রোগীরা।

‘আর্থিং ক্যাবল’ চুরির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিটি স্ক্যান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী। তিনি বলেন, কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সচল করা হয় সিটি স্ক্যান। কিন্তু এক মাস না যেতেই খবর এলো সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি থেকে প্রকৌশলী পাঠিয়ে দিই। তবে এবারো টিউবে সমস্যা হয়। কি জন্য টিউব নষ্ট হয়ে যায়, তার কারণ খুঁজতে থাকে প্রকৌশলীরা। পরে জানা যায় সিটি স্ক্যানের পাওয়ার ‘আথির্ং ক্যাবল’ চুরি হয়েছে। যেটা প্রায় দেড়শো ফুট মাটি খুঁড়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। এ ক্যাবল সিটি স্ক্যানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলো।

‘আর্থিং ক্যাবলের’ সঙ্গে সিটি স্ক্যানের কি সম্পর্ক এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সিটি স্ক্যান চালানোর জন্য নির্দিষ্ট করে বিদ্যুতের ভোল্টেজ প্রয়োজন পড়ে। কিন্ত বিদ্যুতের এ রকম ভোল্টেজ সমানভাবে পাওয়া যায় না। কখনো ভোল্টেজ কমে, নয়তো বাড়ে। তাই আর্থিং ক্যাবল দিয়ে যতটুকু ভোল্টেজ দরকার ঠিক ততটা রাখা হয়, বাকিটা মাটিতে চলে যায়। অতিরিক্ত ভোল্টেজ সহনশীল নয়। আর্থিং ক্যাবল চুরি হওয়ায় ভোল্টেজ বেড়ে সিটি স্ক্যানের টিউব জ্বলে গেছে। আমরা এমন ধারণা করছি। তবে টিউবটা এখনও ঠিক আছে কিনা পরীক্ষার জন্য ঢাকা আনা হয়েছে। কয়েকদিন পর জানতে পারবো। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্ত তারা যদি চুরি ঠেকাতে না পারে আমাদের কি করার আছে?’

সরেজমিন গতকাল (৩০ অক্টোবর) দেখা যায় হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের পেছনে জানালার পাশে নীল আর কালো রঙের কাটা ক্যাবল দুটি ঝুলে রয়েছে। যে ক্যাবলটি মাটি থেকে সংযোগ ছিলো তা এখন মাটি থেকে ১০-১২ ফুট উপর থেকে ঝুলে রয়েছে।’

মেডিটেল প্রাইভেট কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে রেডিওলোজি বিভাগের পেছনে প্রায় দেড়শো ফুট মাটি খুঁড়ে এই আর্থিং ক্যাবল সংযোগ করা হয়। সেখানে খরচ হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার টাকা। সিটি স্ক্যানে যে টিউব বসনো হয়েছে সেটি একমদই নতুন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে লাগানো হয় এটি। যেটি জাপান থেকে প্রায় ৪০ লাখ টাকার বেশি দামে কিনতে হয়েছে। যদি টিউবটির কোনো ক্ষতি না হয় বা জ্বলে না যায় তাহলে মেশিনটি দ্রত ঠিক হবে।’

চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে হাসপাতালে সিটি স্ক্যান সেবা শুরু হয়। এভাবে টানা ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেবা অব্যাহত থাকে। তবে ওই বছরের আগস্ট মাসে পুরোনো সিটি স্ক্যানটি অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর ৪ বছর সিটি স্ক্যান বন্ধ থাকে হাসপাতালে। এ সময় কোনো সেবা পায়নি রোগীরা। পরে ২০১৮ সালে নতুন একটি সিটি স্ক্যান বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আরও এক বছর পর ২০১৯ সালের দিকে নতুন মেশিনের সেবা চালু হয়।

এভাবে চলছে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। মাঝে কয়েকবার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এসে ঠিক করে দেয়। সর্বশেষ চলতি মাসের ৬ জুন মেশিনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২৩ জুন মেশিনটি সচল হয়। কিন্ত কয়েক দিন না যেতেই ৪ আগস্ট তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর টানা ২ মাস চালু থাকার পর ৩০ সেপ্টেম্বর সচল হয়। কিন্ত এবার এক মাস না যেতেই ২৪ অক্টোবর থেকে ফের সেবা বন্ধ রয়েছে।

সিটি স্ক্যান সচল থাকতে প্রতিদিন ৫০ জনের পরীক্ষা করানো যেত। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলত এই সেবা। পরীক্ষা ভেদে সিটি স্ক্যান বাবদ চমেক হাসপাতালে ফি ২ হাজার ও ৪ হাজার টাকা। কিন্ত বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা রোগীদের চলে যাচ্ছে এই পরীক্ষার পেছনে।

এদিকে মেশিন অচল হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন ২০-২৫ জন রোগী সিটি স্ক্যান করাতে আসছেন। কিন্ত কোনো সেবা না পেয়ে তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে এমনটাই দাবি করেছেন রেডিওলোজি বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী।

তিনি বলেন, আজ (৩০ অক্টোবর) সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত প্রায় ১০ জন রোগী এসেছিলো। এক রোগী সিটি স্ক্যান করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টারে বুকের সিটি স্ক্যান করাতে ১০ হাজার টাকা দাবি করেছে। এত টাকা না থাকায় নিরুপায় হয়ে তিনি এখানে এসেছেন। কিন্ত আমাদের কিছু করার নেই।’

অন্যদিকে ক্যাবল চুরির প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, এসব তদারকির জন্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠান থেকে তো একজনকে রাখা হয়েছে। চুরির বিষয়ে তাদের লোক কি করেছে? তবে সেখানে আর্থিং আরও দুটি রয়েছে। যেটা চুরি হয়েছে সেটা আবার সংযোগ করা হবে। এটা বড় কোনো সমস্যা হবে না। হাসপাতালে তো কত কিছুই চুরি হয়। সেদিন মোবাইল চুরি করতে এসে ধরা পড়েছেন এক মহিলা।

চুরির বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না সেভাবে অভিযোগ করা হয়নি।’

সিটি স্ক্যানের টিউব নিয়ে তিনি বলেন, প্রকৌশলীরা নিজেরাও জানে না টিউবটি নষ্ট হয়েছে কিনা। এখন ঢাকায় নিয়ে গেছেন। সেখান থেকে খবর আসলে জানা যাবে।’