জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা »
ইলিশের জোয়ার-ভাটা কাটিয়ে, মাছের সুদিন-দুর্দিন পেরিয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বঙ্গপোসাগর উপকূলে এখন জমে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। তরতাজা ইলিশ মাছের স্বাদ নেওয়া শেষে উপকূলজুড়ে চলছে এখন মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরির ব্যস্ততা। তাই পরিবার নিয়ে জেলেরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিভিন্ন মাছের শুঁটকি তৈরিতে। আর কম দামে এসব শুঁটকি কিনে আসল স্বাদ পেতে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং চট্টগ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং খুচরা ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন সমুদ্রের উপকূলে।
সরকারি পর্যবেক্ষণ, অনুদানের মাধ্যমে যদি এই শিল্পের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়া হয় তাহলে এই শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন উপজেলার গহিরা এলাকার শুঁটকি কারিগর এবং ক্রেতারা। দেশজুড়ে উপকূলের এই শুঁটকির চাহিদা রয়েছে বলে জানান উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. রাশিদুল হক।
সরেজমিনে উপজেলার উপকূলীয় উঠান মাঝির ঘাটে দেখা যায়, প্লাস্টিক বিছিয়ে শুকানো হচ্ছে ছোট ছোট নানা রকমের মাছ। জেলেরা বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঝেরে ঝেরে ছোট চিংড়ি শুঁটকিগুলো থেকে ময়লা আবর্জনা আলাদা করছে। আর মেয়েরা ছোটো-বড় শুঁটকি আলাদা আলাদা করে বেছে রাখছেন। এসব শুঁটকি তৈরি হওয়ার পর ড্রাম, লাই, বস্তায় ভরে ট্রাকে করে এসব নেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাই, সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্থে যাচ্ছে গহিরার এসব শুঁটকি।
চিংড়ি মাছের শুঁটকি তৈরির কারিগর আব্দুনন্নবী বলেন, আমরা এখানে প্লট ভাগ করে তেরপাল, প্লাস্টিক দিয়ে চিংড়ি শুকানোর জন্য তা প্রস্তুত করি। তারপর সাগর থেকে চিংড়ি এনে বিক্রি করা জেলেদের কাছ থেকে চিংড়ি মাছ কিনে তেরপালে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করি। প্রতিবছর এই ঘাটে প্রায় কয়েক হাজার মনুষ এই শুঁটকি তৈরি করার কাজে নিয়োজিত থাকে। আমাদের প্লটে আছে ২০ জন। এই শুঁটকি ১দিনেই তৈরি হয়ে যায়। ১০-১১ দিন পর পর তেরপালসহ সব কিছু পরিবর্তন করে আবার নতুন করে জায়গা তৈরি করি। এরকম এক ডালায় আমাদের শ্রমিকের মজুরি, মাছের দাম, জিনিসপত্র সব মিলে লাখ টাকার উপর খরচ হয়। তবে সব মিলিয়ে বেশির ভাগ সময় লাখ-দেড় লাখ টাকা লাভ হয়। এইভাবে শীত মৌসুমে ৩-৪মাস পর্যন্ত এই শুঁটকি তৈরির কাজ চলবে বলেও তিনি জানান।
পেকুয়া রাজাখালী থেকে এসে উপকূলে শুঁটকি তৈরি করছেন জাকের হোসেন (৬০) নামের এক শুঁটকি কারিগর। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর এই মৌসুমে এই অঞ্চলে আসি শুঁটকি তৈরি করার জন্য। স্থানীয়দের সাথে পার্টনার হিসেবে আমরা এইকাজটা করি। এক টুরি (খাঁচা) মাছ কিনতে খরচ হয় ১৫০০ টাকা, তারপর এই মাছ শুকানোর পিছনে খরচ হয় ৫০০টাকা। এক তেরপালে এরকম ২০-৩০ খাঁচা মাছ শুকানো হয়। এখন মাত্র শুরু। পুরো শীতব্যাপী শুঁটকি তৈরির কাজ চলমান থাকবে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার শুঁটকি বিক্রি হয় চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকার শুঁটকির আড়তগুলোতে। একেকটি শুঁটকি মহাল সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ মণ শুঁটকি বিক্রি করে। খুচরা বড় সাইজের চিংড়ি মাছের শুঁটকি ৭০০-৮০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ৫০০-৬০০ টাকা এবং ছোটো সাইজের ৩০০টাকা করে বিক্রি করা হয়। এছাড়া শুঁটকির গুড়াও বিভিন্ন মাছের খাদ্য হিসেবে ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়। কোন ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে এখনকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
গহিরা উপকূলের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল নবী বলেন, আমরা সমুদ্র থেকে আনা মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি করি। তারা এসব মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন। আমি ছাড়াও এখনকার অনেক মাছ ব্যবসায়ী শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রাশিদুল হক বলেন, শীত মৌসুমের শুরু থেকেই উপজেলার উপকূলে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। আমরা প্রতিবছর শুঁটকি উৎপাদন বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং তদারকির মাধ্যমে শুঁটকি উৎপাদন বাড়াচ্ছি। সে হিসেবে ২০২১ সালে ৩০ টন শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালে উৎপাদন বেড়ে ৫০টন হয়। এবার ৭০টন চিংড়ি শুঁটকি তৈরির লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সাগরে মাছ কম থাকায় এবং মাছের দাম বেশি হওয়ায় বড় মাছ জাতীয় শুঁটকি তৈরি কাজ এখনো শুরু হয়নি। সাগরে মাছ পড়লে রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা, পোপাসহ বিভিন্ন মাছের শুঁটকি তৈরির কাজ শুরু হবে। বিষমুক্ত এসব শুঁটকি দেশের উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে বগুড়া, দিনাজপুর অঞ্চলে বেশি যায়।
এছাড়া দেশের বাইরে ভারতেও এই শুঁটকি কদর রয়েছে বলে জানান উপজেলার এই সিনিয়র মৎস্য অফিসার।