আশরাফ নুর
অগ্রহায়ণের শুরু। গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি সন্ধ্যায়। নগর ছেড়ে যেতে যেতে শীত জেঁকে বসছে ধীরে ধীরে। যদিও শীতকাল নয়, তাই আগাম প্রস্তুতি নেই শীত নিবারণের। এই হিম বাতাস মনে করে দিল শীতকাপড়ের কথা। এমন শীতে কিসের যেন প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি, কিসের যেন শূন্যতা। আগাম শীত মনে করিয়ে দিল আমার প্রিয় শীতকাপড়ের কথা। শীতে নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকে এটি। সেই প্রিয় শীতকাপড়ের নাম শাল। গত শীতের পর খররোদ ও গরমে শালটি যে অবসরে গেল আলমারি থেকে আর বের করা হয়নি। নির্জীব স্তূপ হয়ে আছে আলমারিতে। তবে এখন উৎকৃষ্ট সময় ছাইরঙা প্রিয় শালটি বের করার।
শীতপোশাকের ক্ষেত্রে খুব পরিচিত নামের মধ্যে একটি হলো শাল কিংবা চাদর। সকালের নরম রোদ কিংবা বিকালের কুয়াশার আগমনে উষ্ণ রাখে এই শাল। শিশিরভেজা হিমভোর। কোথাও পাখির কলতান, কোথাও দৈনন্দিন ব্যস্তময় শব্দ। হিমেল হাওয়ার দিন পোশাক-অনুষঙ্গ বেছে নেওয়া হয় শীতের কথা মাথায় রেখেই। এমনকি রাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়ও শীতের কথাই থাকে চিন্তায়। বাঙালি পুরুষ কিংবা নারীই বলেন শীতে শাল পরবেন, এ আর নতুন কী! শীতের সময় উষ্ণতা পেতে শাল তো নিত্যপরিধেয়। ঘরের কাজেই হোক আর অফিস যাওয়ার সময়ই হোক, শাল প্রচলিত শীতপোশাক।
এই শীতে গরম কাপড়ের তালিকায় শাল পুরনো হলেও শালের আবেদন কখনও ফুরানোর নয়। বরং স্টাইলিশ শীতপোশাকের তালিকায় শালের রয়েছে উজ্জ্বল উপস্থিতি।
রাতে বাড়িতে পৌঁছেই শালটি আলমারি থেকে বের করি। সকালে শাল পরেই বের হলাম। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তাপ বাড়ায় শাল খুলে রাখলাম। সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাইÑÑ আড্ডাও অনেক্ষণ হলো। রাত দশটা বেজে গেল, টেরও পেলাম না। হালকা হিম বাতাস ফের জানান দিল সেই শালের কথা, ভাবছি শালহীন কেন বের হলাম! এই শাল ছাড়া যে আমার কষ্ট হয়, শীতে কাবু হতে হয়- তা হাড়ে হাড়ে বুঝছি এবার। তবে দিনকয়েক গেলে অভ্যস্ত হয়ে যাব দায়িত্বসহকারে সঙ্গে নিতে।
আড্ডা থেকে থেকে বের হতেই শীত চেপে ধরলো। বন্ধুর বাড়ি পাহাড়ে হওয়াতে চারদিক কুয়াশার চাদরে যেন ঢেকে গেছে। এই সময়ে এতো কুয়াশা! এত শীত! শীতকাল তো আসেনি এখনো। এত প্রশ্নের মাঝেও শালের কথাই বারবার সামনে আসছে। কিন্তু কি করার, বাড়ি থেকে বের হতে ভুলে গেছি শাল নিতে। এই যেন ভুলে যাওয়া কিংবা শালের কথা মনে না রেখে অবহেলা করার দরুন শাস্তি বটে।
বাইরে ঠান্ডা কুয়াশা বেশি হওয়ায় বাড়ি ফিরে এলাম। এবার মনে পড়ে গেল শাল নিয়ে সব পুরনো কথা। আমার হারানো একেকটি শালের একেকটি গল্প মনে পড়ছে আজ। তবে এসবের প্রায়ই শাল হারানোর পেছনে একেকটি গল্পও রয়েছে।
এক শীতের রাতে মেডিকেলে গেলাম বন্ধুর আত্মীয় এক রোগীকে দেখতে। রোগী দেখে চমেক হাসপাতাল থেকে নেমে রঙ চায়ের ধোঁয়ার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলতে বলতে অনুভব করলাম ঠান্ডা বাড়ছে। দেখলাম সেই বন্ধুর গায়ে শুধু শার্ট, সাথে আর কোন শীতকাপড় নেই। বললাম, ‘তুই তো সারারাত মেডিকেলে থাকবি, ঠান্ডা বেশি পড়ছে, আমার শালটি রেখে দে।’ বলেই দিয়ে আসলাম। সেই রেখে যাওয়া শাল আর ফিরে আসেনিÑÑ এই যে শাল হারানোর পালা শুরু আমার।
এক রাতে মেডিকেল থেকে হেঁটে আসছি বাসায়। দেখি, শীতে কাঁপছে ফুটপাতের বাসিন্দারা। গায়ে ময়লাযুক্ত ছাইরঙা পতলা শাল, কেউ শুয়ে আছে নানা আকারের শাল জড়িয়ে আর কেউ বসে আছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত শাল জড়িয়ে। আর কাউকে দেখছি টঙের চা দোকানের পাশে শাল জড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। তারা কয়েকজন বৃদ্ধ। গরিব ও দুস্থদের জন্য শাল এ শীতে কত দরকারি- এ দৃশ্য না দেখলে বুঝা যায় না। কিছুদূর গিয়েই দেখি, দামি কালো গাড়ি থেকে নামছে সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা এক ভদ্রলোক। গায়ে কালো কোট তার ওপর কালো শাল জড়ানো।
চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে আমার। ভাবছি, মানুষের মাধ্যে কত বৈষম্য অথচ শীত কিন্তু সমহারে পড়ছে। শীত নিবারণে হাতিয়ারও প্রায় একই, শুধু গুণমানে ভিন্ন।
শীতের অন্য কাপড় ব্যবহারে অভ্যস্ত নই, তাই মেডিকেল থেকে ফিরে পরদিন ফের শাল কিনে নিলাম আরেকটি। সেই শালও অন্য এক রোগী দেখতে গিয়েই খোয়া গেল। যতদূর মনে পড়ে, আমার শখের যত শাল এভাবেই হারিয়েছি। এখানে তাদের প্রয়োজনীয়তা আমার কাছে মানিবক মনে হয়েছে, তাই নিজের প্রয়োজনীয়তার কথাকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ হয়নি।
শীতকালে এক বন্ধুকে উপহার দিয়েছিলাম একটি শাল। অন্য শীতকাপড়ে মন টানেনি আমার। তাই শালই উপহার দিলাম। আমার সহধর্মিণীকে প্রথম উপহার বই দিলেও দ্বিতীয় উপহারটি ছিল শাল। খাদির শাল। এই শীতেও নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকুক শাল।
তীব্র শীতে উষ্ণতা দিয়ে যাক শাল।