শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের কারিগর। একজন মানুষের জীবনে মা-বাবার পরই জীবন গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন তার শিক্ষক। দক্ষ মানবসম্পদ ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ বিনির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতেও তাদের ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বের উন্নত এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশও শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষককে জাতির মেরুদণ্ড, কারিগর- এ ধরনের কত অভিধায় না সিক্ত করি আমরা। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষককের স্থান কোথায়? সে প্রশ্নের উত্তর আমরা যা পাব তা অত্যন্ত অপমানজনক। বছরের অধিককাল ধরে বাংলাদেশে শিক্ষকদের ওপর সংঘটিত কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে আমরা মরমে মরে যাই।
আসলে আমাদের গোড়াতেই আছে ভুল। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ সবকিছুই আমাদের সঠিকভাবে এগোয়নি।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বিষয়গুলো আবার আলোচনায় এসেছে। স্কুল পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিনল্যান্ড বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃত। এর মূল কারণ কোনো আড়ম্বরপূর্ণ পাঠ্যক্রম নয়; বরং শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। শিক্ষকদের কেন্দ্রে রেখে তাদের পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছে। সেখানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষকই শিক্ষার্থীর প্রকৃত গাইড। পাঠ্যবই শুধু সহায়ক উপকরণ, শেখানোর ধরন ও প্রয়োগ পদ্ধতি ঠিক করেন শিক্ষকরা। তাই প্রতিটি শিশুই পায় ভিন্ন ভিন্ন যত্ন, আর মূল্যায়নের মূল লক্ষ্য থাকে শেখার অগ্রগতি নিশ্চিত করা, কেবল পরীক্ষায় পাস নয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ভালো ফলাফলকে প্রাধান্য দেয়া হয়। বাংলাদেশে পাঠ্যক্রম নিয়ে বারবার পরীক্ষা চালানো হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ থাকে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত দুটি পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক হওয়ার বদলে প্রতিযোগিতার মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ফিনল্যান্ডে ১২ বছর শিক্ষা শেষে মাত্র একটি পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও শিক্ষার্থী একই বিষয়ে পুনঃপরীক্ষার সুযোগ পায়।
জাপান, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ যারা শিক্ষায় অগ্রসর দেশ তারা দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের ওপর জোর দেন। এছাড়া মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বেতন কাঠামো এখনো দুর্বল। দেশে পাঠ্যক্রম বারবার পরিবর্তন করে যতই আধুনিক করা হোক, শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। দেশে শিক্ষকদের প্রতি সেই আস্থা ও মর্যাদা আমরা দেখাতে পারছি না। শিক্ষকরা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণশক্তি হয়ে উঠতে পারেননি।
আমাদের দেশে আমরা কী করেছি। একেতো বহুদাবিভক্ত শিক্ষাপদ্ধতি তার ওপর শিক্ষকদের বেতনভাতা, সুযোগসুবিধা এত কম যে, তা অনেকটা লজ্জাজনক। শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করে শিক্ষার সঠিক বিকাশ কখনও সম্ভব নয়।