ফজলে রাব্বী দ্বীন
‘শুভ জন্মদিন তাসনিম, তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে এই ছোট্ট একটি উপহার।’
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার। কৃতজ্ঞ হলাম।’
দিনের শুরুটা এমন একটি মধুময় বসন্ত দিয়ে শুরু হবে কল্পনাও করতে পারিনি। প্রফেসর ড. আসাদুজ্জামান চৌধুরী। যার নাম, যশ, খ্যাতি ছড়িয়ে আছে দেশের কোণায় কোণায়। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণামূলক আর্টিকেল লিখে নিজের নামটাকে আরও অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন। ভার্সিটিতে প্রথম পা রেখেই এমন একজন প্রফেসরের চারপাশে ঘুরঘুর করা অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু নয়! কিন্তু দুই মাসের মাথায় লোকটির সাথে এতটা ভাব হয়ে যাবে তা অবিশ্বাস্যই বটে।
জন্মদিনের আজ দিনটা ভালোই কাটবে। ক্যাম্পাস থেকে বের হতে না হতেই এ পর্যন্ত তিন জনের কাছ থেকে শুভেচ্ছা পেয়েছি। কাঁধের ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন শিমুলতলীর মোড়ে এসে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে সময় এগারোটা। কড়ই গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে লাল কাগজে মোড়ানো স্যারের দেয়া উপহারটি খুলে দেখি ‘অসমাপ্ত উপসংহার’ শিরোনামে একটি উপন্যাস। স্যারের লেখা বইটি পেয়ে খুশিতে বুকটা ভরে গেল। সযতেœ ব্যাগের ভিতর সেটি গুঁজে রেখে সালনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা একটি মিনি বাসে চড়ে বসলাম। উদ্দেশ্য ছোট ভাই আরিফের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চাওয়া। বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া হয় না দু’বছর হলো। একটা টিউশনির পাশাপাশি বিভিন্ন কোচিংয়ে দু-একটা করে ক্লাস নিয়ে যা আসে তাতেই আমার বেশ চলে যায়।
কিন্তু এ মাসে একটা সাইকেল কিনতে গিয়ে কিছুটা অর্থসংকটে পড়তে হয়েছে। আরিফের সাথে পরিচয় হয়েছিল চার বছর আগে সিরাজগঞ্জ কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়। একদিন সকালে অপরিচিত আরিফ আমার বাসার সামনে কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভাইয়া আপনার রক্ত কি ও-নেগেটিভ?’
থতমত হয়ে আমি বলেছিলাম- ‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’
শীতের ঝরা পাতাগুলো যেমন ফাগুনের সুগন্ধ পেয়ে প্রাণ ফিরে পায় তেমনি আমার উত্তর শুনে আরিফের চোখেও ফুটে উঠেছিল পলাশ ফুল। হঠাৎ-ই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমার দু’হাত চেপে ধরে বলেছিল, ‘ভাইয়া আমার মা-কে দয়া করে বাঁচান। এক্ষুনি এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। ডাক্তার বলেছে রক্ত না মিললে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না।’
চৈত্রের রোদে পোড়া একটি ক্লান্ত-শ্রান্ত শালিক পাখিকে সেদিন দেখেছিলাম কিভাবে শান্তিতে ঘরে ফিরে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতে ফেরার আগেই আরিফের বাড়িতে পা রাখতে হয়েছিল সেদিন। সেই থেকে দূরের আরিফ হয়ে গেছে কাছাকাছি এক আপনজন।
সাঁই সাঁই করে বিরতিহীন মিনি বাসটি সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। ক্লান্ত শরীরের অলস চোখ দুটো ঘুমের সাথে খেলা খেলছে দেখে ভালোই লাগছে। হঠাৎ বাসটি যখন শিববাড়ি মোড় অতিক্রম করতে যাবে এমন সময় বুকের ভিতরটা ধরাস করে উঠলো। গায়ের লোমগুলি দাঁড়িয়ে যেন কথা বলবে। জানালার বাইরে লম্বা ঐ কড়ই গাছটির দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, এই গাছটির নিচেই কেউ একদিন আমার গলায় ছুরি ধরেছিল, আমার সুন্দর পৃথিবীটাকে অসুন্দর করে দিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যেই।
ঘটনাটি মাসখানেক আগের হলেও হাহাকারে নিঃস্ব হওয়া বুকের ভেতরটা এখনো আমার হু হু করে কাঁদে। এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এ পথের পাশ দিয়ে চলতে গেলে। সেদিন রাত বেজেছিল দশটা। ইউনিভার্সিটি থেকে দুই মাইল দূরে জয়দেবপুর স্টেশনে গিয়েছিলাম শিপলব দাদার সাথে দেখা করতে। শুধু দেখা করতে নয় টাকা আনতে। বাড়ি থেকে ছোট বোন ফোন করে বলেছিল বাবার অসুস্থতার কথা। ক্রমশ শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়েছিল। গ্রামের বাড়ির ছোট্ট সেই দীঘিটা শেষমেষ শিপলব দাদার কাছে বিক্রি করা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। সেই টাকাটা হাতে পেতেই ছুটে গিয়েছিলাম স্টেশনে। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে দাদা ছোট্ট একটি মিনি ব্যাগে পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিল,‘বাকিটা পরে নিস। আপাতত এই টাকাটা নিয়ে তোর বাপরে হাসপাতালে ভর্তি করা গিয়ে। তোর জন্যই স্টেশনে থেমেছিলাম নইলে অনেক আগেই ঢাকায় চলে যেতাম। মাছের পোনা কিনতে হবে। কালকে গ্রামে গিয়ে তোদের ওই দীঘিতে মাছ ছাড়বো। তুই আর দেরি করিস না। কাল সকাল সকাল ভার্সিটি থাইকে ছুটি নিয়া বাড়ি ফিরে যাস।’
টাকাটা হাতে পেয়ে বাবার জীবনটাই যেন হাতে পেয়েছিলাম। দ্রুত স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়ি ঠিকই কিন্তু অগত্যা গাড়ি না পেয়ে শিববাড়ি মোড় পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হচ্ছিল। মায়ের দেওয়া ঘড়িটা তখনও হাতেই। রাত এগারোটা বাজতে বেশি দেরি নেই। একাকী এ পথে আরো কত এসেছি-গিয়েছি একটুকুও বুক কাঁপেনি। কিন্তু সেদিন রাতে খুব ভয় করছিল। এতটা নিঃসঙ্গ লাগবে জানলে শিমুল বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। এসব যখন ভাবছিলাম হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে আমার নাম ধরে ডাক দিল – ‘তাসনিম ভাইয়া’।
পিছন ফিরে দেখি চাঁদনী রাতের ঝাপসা আলোয় নাম না জানা কোন এক বালক দৌড়ে এদিকেই আসছে। কাছে এসে বলল, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন ভাইয়া? আমি অর্কিড। সেই যে গতকাল আপনার সাথে ফেসবুকে কথা বললাম। আপনি আমাকে বিভিন্ন পত্রিকার ইমেইল এড্রেস দিয়েছিলেন। কীভাবে সাহিত্য লিখে পাঠাতে হয় সেটিও শিখিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘ও হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। তো অর্কিড তোমার মেডিকেল প্রস্তুতি কেমন চলছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের দোয়ায় অনেক ভালো।’
অন্ধকার রাতে একজনকে সঙ্গী পেয়ে মনটা হঠাৎ ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিল। পায়ের শব্দের তালে তালে গল্পও জমে উঠেছিল বেশ। শিববাড়ি মোড়ের কাছাকাছি এসে সেই কড়ই গাছটির নিচ দিয়ে যেই এগুচ্ছিলাম অমনি অবিশ্বাস্য এক ঘটনায় আমার সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসলো। স্বাভাবিক একটা মানুষ কিভাবে নৃশংস একটা জানোয়ারের মত আচরণ শুরু করেছিল তা অবিশ্বাসযোগ্য। অর্কিড হঠাৎ-ই আমার সামনে তেড়ে এসে গলায় ছুরি ধরল।
চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। মানুষের কোন আভাস নেই। দোকান-পাটগুলোও সব বদ্ধ। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো নেই। অর্কিডের চেহারা ক্রমশ কোমল থেকে হিংস্র হতে লাগল। আমি আশ্চর্য হয়ে মূর্তির মত তাকিয়েছিলাম ছেলেটির দিকে। তার কপাল চুইয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। অর্কিড বলল, ‘এক্ষুনি পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যাগটা পকেট থেকে বের কর।’
আমার কাছে এতগুলো টাকা আছে সে কীভাবে জেনেছিল? ঐ কুয়াশাচ্ছন্ন ভয়ঙ্কর রাতটি চিরকালের জন্য অন্ধকারকে বরণ করে নিবে তবুও সাক্ষী থাকবে ঐ টাকার ব্যাপারে একটা পিঁপড়া পর্যন্তও জানতো না।
‘আমার কাছে এতগুলো টাকা আছে তুমি কীভাবে জানলে?’ – আমার কথা শুনে অর্কিডের চোখ লাল হয়ে উঠল। একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে তারপর হঠাৎ গর্জন দিয়ে উঠল। পরক্ষণেই হিংস্র বাঘের মত আমার বাম হাতের কনুইয়ে লাগিয়ে দিল ছুরির একটা ভয়ঙ্কর দাগ। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে ভুলে গিয়েছিলাম। দুই দেয়ালের মাঝখানে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করতে না পেরে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। অর্কিড আরো বিষ্ময়ে ছুরির ধারালো অংশ দিয়ে আমার গলাটা যখন নামিয়ে দিতে চাইল অবিলম্বে তখন পকেটে হাত ঢুকাতে বাধ্য হলাম। টাকাটা হাতে পেয়ে জানোয়ারটা বলল, ‘তোকে আমি অনেকদিন ধরেই ফলো করি।
গতকাল ফেসবুকে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিলাম দেখে তুই বলেছিলি আগামীকাল টাকা হবে। ব্যস লেগে পড়লাম। স্টেশনেই টাকাটা ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেই সুযোগটা দিসনি। এখন মজা করে ইয়াবা টানবো।’
সেদিন রাতের পর থেকেই আমার আকাশে আর কোনদিন প্রভাতের পাখিরা ডাকেনি, সুগন্ধ ছড়ায়নি প্রকৃতির কোন ফুল। মাটির উপরের বটবৃক্ষের ছায়া সরে গেছে সেদিনের পর থেকেই। বাবার অপারেশনের সমস্ত টাকা হারিয়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও ওনার চোখে অশ্রু দেখিনি। শুধু সবার অশ্রুকে ফাঁকি দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছিল সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে। আকাশের ঐ উজ্জ্বল তারাটা এখনো বাবা হয়ে হেসে হেসে বলে, ‘আমরা তো এই পৃথিবীতে আসি মৃত্যুকে বরণ করতেই।’
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে, সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস। বৃষ্টির ছিটা ভিতরে এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাসের জানালাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে হলেও সামনের সিটে বসা ভদ্রলোকটির জন্য ব্যর্থ হলাম। অসহায়ের মত কিছুক্ষণ বাইরের দিকে হা করে তাকিয়ে তারপর ব্যাগ থেকে স্যারের দেওয়া উপন্যাসটি বের করলাম। দু-একটা পৃষ্ঠা উল্টাতে যাব এমন সময় বাসের চালক প্রচ- জোরে হার্ডব্রেক চাপলো। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে গিয়ে সামনের সিটের সাথে ধাক্কা খেয়ে জানালা বরাবর মুখটি বের হয়ে আসলো। কিছুক্ষণ যেন সুনসান নীরবতা। তারপর একটা বাচ্চা চিৎকার করে উঠল। কে যেন চেঁচিয়ে বলছে- সিটের সাথে ধাক্কা লেগে বাচ্চার মাথা ফেটে গেছে।
কয়েকজনের মুখ থেঁতলে গেছে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চোখের চশমাটা হাতে নিয়ে দেখি বাম চোখের গ্লাসটা ফেটে গেছে। সামনের সিটের ভদ্রলোকটি পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, ‘আমার দাঁত ভেঙেছে, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। কেউ আমাকে সাহায্য করো।’ পিছন থেকে মস্ত একটা লোক জুতা হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে শায়েস্তা করার জন্য এগিয়ে দেখে ড্রাইভার পালিয়েছে। জানালার বাইরে নজর যেতেই দেখি, আশেপাশের সকল মানুষ দৌড়ে আসছে এদিকে। কে যেন বলে উঠল- অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একজনের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে।
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বাস থেকে নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাথায় ব্যথা টনটন করছে। নিচে নেমে দেখি রাস্তায় যেন রক্ত বন্যা বইছে। দশ থেকে বারো ফুট দূরে রক্তমাখা শরীরে একটা যুবক রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীরের কোন হাড্ডি হয়তো আর আস্ত নেই। কয়েকজন মানুষ ধরাধরি করে একটা ভ্যানের উপর তুলে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। এমন সময় কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছেলেটি মরে গেছে, ও আর বেঁচে নেই। হাসপাতালে নিয়ে কোন লাভ হবে না।’
দুর্ভাগা ছেলেটিকে দেখার জন্য ভিড় ঠেলে ভ্যানের সামনে এগিয়ে গেলাম। এমন সময় আকাশ যেন মাথায় ভেঙে পড়ল। একি, এ কাকে দেখছি আমি! এতো অর্কিড! আমার সর্বনাশ করেছিল যে ছেলেটি তার সর্বনাশ যে এভাবে হবে তা কখনও কল্পনা করে দেখিনি। রক্তমাখা হাতে অর্কিড হঠাৎ-ই যেন আমার চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোর অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে গেছি। আমাকে শেষ করে দিলি কেন? কেন ক্ষমা করলি না আমাকে?’