সারাবিশ্ব যখন প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, তখন আমাদের দেশে তার ঠিক উল্টো চিত্রটাই দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে, চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্যে ৬ একর জমি দেওয়া হবে একটি প্রতিষ্ঠানকে। তারা দুই ধাপে এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করবে। জানা যাচ্ছে, ওই প্রকল্পের অধীনে এখানে ৫০০ শয্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ১০০ আসনবিশিষ্ট একটি মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ট্র্যাক) জানিয়েছেন, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রেলওয়ের সঙ্গে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের চুক্তি হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক জানাচ্ছেন, শিগগিরই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু হবে।
চট্টগ্রামের সচেতন সুধীমহলে রেলওয়ের এই প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য হচ্ছে, প্রথমত, সিআরবি এলাকাটি হচ্ছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ‘হেরিটেজ এরিয়া’। দ্বিতীয়ত, এখানে রয়েছে অনেকগুলো শতবর্ষী বৃক্ষ। এই পরিবেশবান্ধব ও ঐতিহ্যবাহী বৃক্ষকর্তন করে এখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণের কথা ভাবাটাই পাপ। এটা হবে একটি আত্মঘাতী প্রকল্প। এ প্রকল্প অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের ধারণাটির আমরা বিরোধী নই। কেননা এটি একটি জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ। তবে এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এই চট্টগ্রাম শহরেই রেলওয়ের অজস্র অব্যবহৃত বা পতিতভূশি পড়ে আছে। সে রকম কোনো স্থানে প্রকল্পটি স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিচালকও প্রকল্পটির স্থান নির্ধারণের এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন। সিডিএ’র ভাষ্য, কোনোভাবেই সিআরবি এলাকায় ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা যাবে না। কেননা সেটা আমাদের মাস্টারপ্লানবিরোধী হয়ে যাবে। তাছাড়া সিআরবি আমাদের ঐতিহ্যিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত। এখানে কোনোভাবেই হাসপাতাল নর্মাণের অনুমতি দেওয়া যাবে না। এখানে হাসপাতাল নির্মিত হলে হাজার-হাজার লোকজন চিকিৎসা নিতে আসবে। তাদের পদভারে তখন পরিবেশ বিনষ্ট হবে। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য এই যে, সিআরবি তো রিজার্ভ এলাকা। সেখানে অনেকগুলো শতবর্ষী বৃক্ষ রয়েছে। যে বৃক্ষগুলোই মূলত ওই এলাকার নান্দনিক আকর্ষণ বাড়িয়েছে। কোনোমতেই নগরীতে পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কোনো ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না।
বস্তুত হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে রেখে সিআরি’র মতো দেশের অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি স্থানের ঐতিহ্য ধ্বংসের এই প্রয়াসকে কোনো মতেই সমর্থন করা যায় না। এমনিতেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবিশেষের হঠকারী ও অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের কারণে প্রকৃতির লীলাভূমি চট্টগ্রামের অনেক প্রাকৃতিক দৃশ্যপট ও নান্দনিক স্থাপনা ধ্বংসা বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই সাথে মানুষের জীবনধারাও নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিকত্ব হারাতে বসেছে। এই অবস্থায় প্রকল্পটি রেলওয়ের মালিকানাধীন অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে নেওয়াই হবে সুবিবেচনাপ্রসূত ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সেই সুমতি উদয় হবে, আশা করি।
মতামত সম্পাদকীয়