চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থা ও তার ভবিষ্যৎ

প্রফেসর ড. মো: আবুল কাসেম »

৪টি বিভাগ নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। বর্তমানে ৯টি অনুষদ আর ৬টি ইনস্টিটিউটের অধীনে ২৭,৫৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সংখ্যা ৯০৬ জন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী সংখ্যা ২০৮৮ জন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হলো ১:৩০ এবং কর্মকর্তা কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৯.৬। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিম্নের এই আলোচনাআলোচনা।
প্রসঙ্গ ১। শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা: শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধার জন্য রয়েছে ১৫টি হল। ছাত্রদের জন্য ৯টি, ছাত্রীদের ৬টি। ছেলেদের হলে মোট আবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ২৭৪২ এবং মেয়েদের হলে আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা ২৬২১, তাদের সাথে আরও প্রায় ১ হাজার ছাত্রী ডাবলিং করে থাকে। উল্লেখ্য যে, আমার জানা মতে খালেদা জিয়া হলের একটা ৮০০ বর্গফুটের কক্ষে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থী শেয়ার করে থাকে, যাকে গণরুম বলা হয়, সেখানে খাট আর মশারি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, হিসাবে জনপ্রতি জায়গার পরিমাণ হবে ১০ থেকে ১২ বর্গফুট, এই করুন চিত্র বাংলাদেশের কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। আনুমানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সর্বমোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬৬৭৩ অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর ২৪%। বাকিরা ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকার মেস, বাড়ি ভাড়া ও চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করেন।
২। আবাসিক হলগুলোতে খাবারের মান:
ছোট একট টুকরো মাছ কিংবা মাংস, হলুদের গুঁড়া মিশানো প্রতি ৭০০ জনের জন্য ১ কেজি ডাল, ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ, আর কিছু সবজি এই খেয়েই কাটাচ্ছেন আমাদের আবাসিক হলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যা বাংলাদেশের যেকোনো এতিমখানার খাবারের মানের চেয়েও নিম্নমানের। আমাদের পাশেই হাটহাজারী মাদ্রাসা, যেখানে প্রায় ৪ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ২ বেলা খাবার খায় যার মান আমাদের আবাসিক হলের খাবারের তুলনায় অনেক উন্নত।
৩: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ব্যবস্থা:
শহর থেকে চবি ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। আমাদের প্রায় ৬০ শতাংশ (১৬,৫৩০ জন) শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় যাতায়াতের একমাত্র বাহন ২টি শাটল ও ১টি ডেমো ট্রেন, যার লাইন ২টি, বগির সংখ্যা ১০, আসা-যাওয়া সাধারণত: ৭ (রান ১৩১ থেকে ১৪৪) বার। দৈনিক প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী সকাল টা ৭:৩০মি. থেকে ১০:৩০ মি. ৪টা ট্রিপে ক্যাম্পাসে আসে। অন্যদিকে দুপুর ১:৩০মি থেকে ৫:৩০ মিনিটে মোট ৪টি ট্রিপে আবার শহরে ফিরে যায়। একটি বগিতে সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা ৭২টি, কিন্ত আমাদের ২৫০ থেকে ৩০০ জন ছাত্র-ছাত্রী ১টি বগি ব্যবহার করে থাকে, যার মধ্যে কোন আধুনিক সুযোগ সুবিধা নেই। ভিতরে জায়গা না থাকায় ছেলেরা বাধ্য হয়ে ট্রেনের ছাদে ওঠে এবং বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রীরা শহরে টিউশনি শেষে রাতের ট্রেনে বিশেষ করে ষোলশহর থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে বাহির থেকে বখাটে ছেলেরা প্রায়ই ট্রেনকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়ে, তাতে অনেক ছেলে-মেয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়। তাছাড়া ক্লাস চলাকালীন শিক্ষার্থীদেরকে ট্রেন থেকে নেমে চবির জিরো পয়েন্ট থেকে বিজ্ঞান অনুষদ পর্যন্ত ১.৭ কিলোমিটার পথ রোদ ও মেঘ-বৃষ্টিতে হেঁটে যেতে হয়। জিরো পয়েন্ট থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত দূরত্ব ৭০০ মিটার, সেখান থেকে জীববিজ্ঞান পর্যন্ত ১০০০ মিটার। উল্লেখ্য যে, আমাদের শিক্ষকদের সন্তানরাও কিন্তু একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। আমাদের শিক্ষার্থী অনুপাতে ট্রেনের বগি ও ট্রিপ সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তথ্য নিয়ে জানা গেল, রেলের বর্তমান অবকাঠামোতে এগুলো বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। এ নিয়ে প্রশাসনকে সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আগাতে হবে।
অন্যদিকে শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে প্রায় ২৪ টি বাস তার মধ্যে ১২ (২ টি বড় ও ১০টি ছোট) এসি, যাদের মোট আসন সংখ্যা প্রায় ৪০০। হিসাব মতে প্রতিদিন প্রায় ৪৫% শিক্ষক এসি বাস ব্যবহার করার সুযোগ পান, বাকিরা নন এসিতে যাতায়াত করেন। এসি বাসের ইতিহাস কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব দীর্ঘদিনের নয়। মাত্র ৬ বছর আগে ভিসি ইফতেখার স্যারের সময় ইউসিবিএলের একটি বড় এসিবাস উপহারের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। আমরা শিক্ষকরা কিন্তু এসি- নন এসি বুঝি না, যখন যা সামনে পাই তাতেই উঠে বসি। নন এসি বাসে চড়ি বলে আমাদের প্রত্যাশা কিন্তু কম নয়, আমরা শিক্ষকরা সবসময়ই চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন আমাদের চেয়ে আরো কয়েক স্তর উপরে ওঠে পরিবার, সমাজ ও দেশ গড়ার কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
উপাচার্য, উপ- উপাচার্য, হল প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের বাসভবন:
ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ- উপাচার্য, হল প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের বাসভবন রয়েছে। প্রত্যেকটা আবাসিক হলে প্রভোস্টদের পৃথক বাংলো ও আবাসিক শিক্ষকদের জন্য হল সংলগ্ন বা খুব কাছাকাছি বাসস্থান রয়েছে কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে অধিকাংশ হল প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকগণ শহরে অবস্থান করছেন। যদিও শর্তানুযায়ী উপাচার্য, উপ- উপাচার্য, হল প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার সুযোগ নেই। নৈতিকভাবে তারা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে থাকতে বাধ্য যাতে করে ক্যাম্পাসে বা আবাসিক হলে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত উপস্থিত হয়ে সমস্যার সমাধান দিতে পারেন।
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতের শাটল ট্রেনের অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার ফলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে শান্ত করতে পারতাম। রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের বীভৎস ছবি দেখে এবং মারা যাওয়ার গুজবে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মত (হিমেল হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী পদক্ষেপ) শিক্ষার্থীদের পাশে যথাসময়ে দাঁড়াতে না পারায় বিশ্ববিদ্যালয় এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হলো। আমরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে এ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের, এর সমস্ত সম্পদ তাদের, এখানে উপাচার্যের নিজস্ব বলতে কিছু নেই। উপাচার্যের বাসভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অলংকার, যা আমাদের সকলের অহংকার, যেখানে বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের অতিথিদের সাথে মত বিনিময় ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
ঐ রাতের ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে শিক্ষকরা (একই হলুদের দুইটি খণ্ড) দুইটি পৃথক ভাবে বিবৃতি দিয়ে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এরই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দুইটি মামলা ও তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন যা তার নিজস্ব গতিতে চলছে এবং চলতে থাকবে। আমরা আস্তে আস্তে সবই ভুলে যাব কিন্তু এই ক্ষতির দাগ রয়েই যাবে। অন্যদিকে কয়েকজন শিক্ষক (যারা হাসপাতালে দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের পাশে রাতভর পাশে ছিলেন) আবেগান্বিত হয়ে গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন আমরা কি “এ ধরনের শিক্ষার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম?” না, একেবারেই না।
অপরদিকে শিক্ষার্থীরাও বলতে পারে আমরাও তো এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় চাই না, যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে “আবাসিক হলে থাকার সুব্যবস্থা, সার্বিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, ঝুকিমুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থা ও সেশনজট মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে না”। আসলে উভয়ের যুক্তিই সঠিক। এই পবিত্র অঙ্গনে একে অপরকে প্রতিপক্ষ ভাবার সুযোগ নেই, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মিলন মেলা, জ্ঞান আহরণের উত্তম জায়গা। আমরা আশাবাদী, আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, ধৈর্য ও মানবীয় গুণাবলী দিয়ে প্রতিবাদের সঠিক ভাষা ও কৌশল খুঁজে পাবে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়টাকে নিজের মতো করে ভালবাসবে। নিচে কিছু সুপারিশ বিবেচনার জন্য তুলে ধরা হলো:
১। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ২টি শাটল ও ডেমো ট্রেনের পাশাপাশি বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা।
২। ট্রেনের লাইনটিকে জিরো পয়েন্ট থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত বর্ধিত করা এবং বগির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বটতলী ট্রেন স্টেশনের সংস্কার করা।
৩। বঙ্গমাতা হলের পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে আরো কয়েকটি ছাত্রী আবাসিক হল নির্মাণের ব্যবস্থা করা।
৪। আবাসিক হলগুলোতে খাবারের মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা।
৫। সেশনজট নিরসনে ১ম বর্ষ শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন ডেটের মত প্রতিবছর গ্র্যাজুয়েশন ডেটও অনুষদভিত্তিক নির্ধারণ করা।
৬। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ এর আদলে চবির ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজকে সাজানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তার জন্য মাউশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা। অযোগ্য ও অনুপযুক্ত শিক্ষকদেরকে বাছাই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যত্র বদলি করা।
৭। গবেষণার সুবিধার্থে ও গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নষ্টের হাত থেকে রক্ষার্থে অন্তত দৈনিক ৫ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা।
৮। শিক্ষকদের জন্য ক্যাম্পাসে একটি বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন তৈরি করা।
৯। বিকালে ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে যে বাস সমূহ (১৭ টি) শহরে ঢুকে তাদেরকে পুনরায় ক্যাম্পাসে ফেরত না নিয়ে শহরে কোন গ্যারেজের ব্যবস্থা করা। তাতে জ্বালানি খরচ বাবদ দৈনিক প্রায় ৭০ হাজার টাকার স্বাশ্রয় হবে এবং গাড়িগুলো দীর্ঘ সময় ব্যবহার করা যাবে। সুপারিসগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিল্পপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশনকে অন্তর্ভুক্ত করে একটা মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে উন্নয়নমূলক কাজগুলোতে এগিয়ে আসবেন, যেমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন একে খান চবির আইন অনুষদ ও সুফি মিজানুর রহমান চাকসু মসজিদ নির্মাণে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পপতি ও ধনী ব্যক্তিরা চট্টগ্রামের অধিবাসী। আশা করি, দলমত নির্বিশেষ এই প্রতিষ্ঠানটি উন্নতির লক্ষ্যে সবাই এগিয়ে আসবেন। সবাই ভালো থাকবেন। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।

লেখক : মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।