সুপ্রভাত ডেস্ক »
একটি ইয়র্কার, এক সমুদ্র গর্জন আর এক আকাশ স্বস্তি! রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার নানা মোড় পেরিয়ে ম্যাচ পৌঁছায় শেষের নাটকীয়তায়। লড়াইটা তখন বাংলাদেশ বনাম রোহিত শর্মার। শেষের আগের ওভারে ভারতীয় অধিনায়ককে দুই দফায় জীবন দিয়ে ম্যাচটাই হেরে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। পে-ুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় শেষ বলে। সেখানেই মুস্তাফিজুর রহমানের ওই ইয়র্কার, রান নিতে ব্যর্থ রোহিত আর বাংলাদেশের জয়। উল্লাসে ফেটে পড়ে শের-ই-বাংলার ঠাসা গ্যালারি।
মেহেদী হাসান মিরাজের অসাধারণ সেঞ্চুরি আর দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুন্যের ম্যাচে শেষ দিকে রোহিতের ব্যাটিং তা-ব সামলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জয় ৫ রানে। তাতে নিশ্চিত হয়ে গেল দুর্দান্ত এক সিরিজ জয়ও।
আগের ম্যাচের চেয়ে গ্যালারিতে দর্শক এ দিন ছিল আরও বেশি। আসন তো পরিপূর্ণ ছিলই, দাঁড়ানো দর্শকও কম ছিল না। ম্যাচের ঘণ্টা দেড়েক পার না হতেই সেই গ্যালারি হয়ে যায় প্রায় নীরব। ২০ ওভারের আগেই যে উধাও বাংলাদেশের ৬ উইকেট! সেই গ্যালারিকেই জাগিয়ে তোলেন মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহ। রেকর্ড গড়া জুটিতে দুজন উদ্ধার করেন দলকে। মাহমুদউল্লাহ পরে ফিরে গেলেও আটে নেমে অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতে নিজেকে নতুন উচ্চতায় তুলে নেন মিরাজ।
প্রথম ম্যাচে মন্থর ব্যাটিংয়ের কারণে প্রবল সমালোনার শিকার হওয়া মাহমুদউল্লাহ খেলেন ৯৬ বলে ৭৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। মিরাজ রয়ে যান শেষ পর্যন্ত। দলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করার পাশাপাশি শেষ সময়ে দ্রুত রানের দাবিও মেটান তিনি চোখধাঁধানো সব শটে। ৬৯ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশ ৫০ ওভারে তোলে ৭ উইকেটে ২৭১।
রান তাড়ায় ভারত শুরুর ধাক্কা সামলে এগিয়ে যায় লক্ষ্যের দিকে। আঙুলের চোটের কারণে ওপেন করতে না পারা রোহিত ৯ নম্বরে নেমে দুর্দান্ত পাল্ট আক্রমণে এলোমেলো করে দেন বাংলাদেশকে। কিন্তু শেষের সমীকরণে আর পেরে ওঠেননি তিনি।
শেষ ৫ ওভারে যখন ভারতের প্রয়োজন ৫৯ রান, ইবাদত হোসেনের ওভারে দুটি ছক্কা ও একটি চারে ম্যাচ জমিয়ে দেন রোহিত। ৪৮তম ওভারে মোহাম্মদ সিরাজকে পেয়ে দারুণ বোলিংয়ে মেডেন নেন মুস্তাফিজ। শেষ ২ ওভারে যখন প্রয়োজন ৪০ রান, মাহমুদউল্লাহর ওভারে দুই ছক্কাসহ ২০ রান নিয়ে উত্তেজনা জিইয়ে রাখেন ভারতীয় অধিনায়ক। ওই ওভারেই ইবাদত ও এনামুল হক দুটি সহজ ক্যাচ ছাড়েন রোহিতের।
শেষ ওভারে ২০ রানের সমীকরণে মুস্তাফিজের প্রথম বলে রান নিতে পারেননি রোহিত। পরের দুই বলেই মারেন বাউন্ডারি। চতুর্থ বল আবারও ডট। শেষ দুই বলে যখন প্রয়োজন ১২, দুর্দান্ত এক শটে ছক্কায় আবার বাংলাদেশকে স্তম্ভিত করে দেন তিনি। শেষ বলে আরেকটি ছক্কা হলেই ভারতের জয়! কিন্তু মুস্তাফিজের ইয়র্কারে কিছুই করার ছিল না রোহিতের।
ম্যাচের প্রথম ভাগ ছিল মিরাজময়। মাত্র ৮৩ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। আট নম্বরে নেমে যেটি ওয়ানডে ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। আগের সেঞ্চুরি করেন সিমি সিং, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আইরিশ অলরাউন্ডার খেলেন ৯১ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস।
আটে নেমে বাংলাদেশের হয়ে আগের সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল মিরাজেরই। গত ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর অপরাজিত ৮১ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
আট নম্বরে নেমে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ডও এখন মিরাজের (৩টি)।
ম্যাচের শুরুর দিকেই আঙুলের চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন রোহিত। হ্যামস্ট্রিংয়ে টানা লাগায় তিন ওভারের বেশি বোলিং করতে পারেননি পেসার দিপক চাহার। তবে মিরাজ আর মাহমুদউল্লাহর কৃতিত্ব তাতে কমছে না খুব একটা।
মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহর জুটির আগে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ছিল দৈন্য দশা। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা দলের টপ ও মিডল অর্ডার ভেঙে পড়ে ভারতীয় বোলিংয়ে।
উদ্বোধনী জুটিতে এ দিন পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ। অধিনায়ক লিটন দাসের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন এনামুল হক।
দ্বিতীয় ওভারে মোহাম্মদ সিরাজকে দারুণ দুটি চার মারেন এনামুল। এক বল পরই স্লিপে রোহিতের হাতে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান তিনি। তবে জীবন কাজে লাগাতে পারেননি। এলবিডব্লিউ হয়ে যান পরের বলেই।
সিরাজ, চাহার ও শার্দুল ঠাকুরের দারুণ বোলিংয়ে স্বস্তিতে খেলতে পারছিলেন না লিটন ও তিনে নামা নাজমুল হোসেন শান্ত। সিরাজের ফুল লেংথ বলের লাইন মিস করে লিটন আউট হন ২৩ বলে ৭ করে।
শান্ত শুরুর অস্বস্তি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু উমরান মালিকের ১৫১ কিলোমিটার গতির ডেলিভারি এলোমেলো করে দেয় তার স্টাম্প (৩৫ বলে ২১)।
ভারতীয় পেসারদের স্বস্তিতে খেলতে পারেননি অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসানও। দুই দফায় তার হেলমেটে লাগে বল, আরেকবার ছোবল দেয় শরীরে। তবে বাংলাদেশের মিডল অর্ডার ভেঙে দেন অফ স্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দর। ২০ বলে ৮ রান করা সাকিবকে ফেরানোর পর তিনি পরের ওভারে টানা দুই বলে বিদায় করেন মুশফিকুর রহিম ও আফিফ হোসেনকেও।
ম্যাচের তখন ১৯ ওভার হয়েছে মোটে, বাংলাদেশের উইকেট নেই ৬টি!
মাহমুদউল্লাহ ও মিরাজের লড়াই শুরু সেখান থেকে। উইকেটে যাওয়ার পরপরই দারুণ দুটি চারে দুজন স্নায়ু থিতু করেন কিছুটা। আগের ম্যাচের ব্যাটিংয়ে উজ্জীবিত মিরাজ শুরু থেকেই ছিলেন সাবলিল। মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়েও দেখা যায় বেশ তাড়না। কার্যকর এক জুটি গড়ে ওঠে আস্তে আস্তে।
৬৩ বলে আসে জুটির ফিফটি। মিরাজ নিজের তৃতীয় ওয়ানডে ফিফটি স্পর্শ করেন ৫৫ বলে। মাহমুদউল্লাহর পঞ্চাশ আসে ৭৪ বলে।
ক্রমে দুজনের ব্যাটের ধার আর রানের গতি বাড়তে থাকে। শতরান পেরিয়ে জুটি এগিয়ে যায় আরও। শেষ পর্যন্ত ৪৬ ওভার পেরিয়ে যাওয়ার পর ভাঙে জুটি। উমরান মালিকের বাড়তি বাউন্সের বল মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে ছোবল দেয়, দারুণ ক্যাচ নেন কিপার লোকেশ রাহুল।
তবে এই জুটির আত্মবিশ্বাস প্রতিফলিত হয় নাসুম আহমেদের ব্যাটে। পেসার হাসান মাহমুদের বদলে একাদশে ফেরা বাঁহাতি স্পিনার ব্যাট হাতে ঝলক দেখান। উইকেটে গিয়েই টানা দুই বলে মারেন দৃষ্টিনন্দন দুটি বাউন্ডারি। রানের ধারা ছুটতে থাকে।
মিরাজ তো শেষ দিকে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। ইনিংসজুড়ে অসাধারণ টেম্পারমেন্ট ও স্কিল মেলে ধরার পর শেষ দিকে তিনি দেখান কর্তৃত্ব আর হাতের জোর। শেষ ওভারে শার্দুলকে দুটি ছক্কা মেরে তিনি এগিয়ে যান শতরানের কাছে। শেষ বলে শতরান ছুঁয়ে ভেসে যান আনন্দে। বাংলাদেশ পৌঁছে যায় লড়িয়ে স্কোরে।
রান তাড়ায় রোহিত না থাকায় শিখর ধাওয়ানের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন বিরাট কোহলি। টিকতে পারেননি দুই ওপেনারের কেউই। ইনিংসের প্রথম বলে মিরাজকে দারুণ এক বাউন্ডারিতে শুরু করেন কোহলি। তবে দ্বিতীয় ওভারেই ইবাদত হোসেনের বলে পুল করতে গিয়ে স্টাম্পে টেনে আনেন তিনি। বাঁধনহারা দৌড়ে ইবাদত ছুটতে থাকেন মাঠময়।
পরের ওভারে আচমকা ছোবল দেওয়া দুর্দান্ত ডেলিভারিতে শিখর ধাওয়ানকে ফেরান মুস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশ পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত শুরু।
ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া ওয়াশিংটন পারেননি সুযোগ কাজে লাগাতে (১১)। মিরাজের বলে বাজে শটে উইকেট বিলিয়ে দেন লোকেশ রাহুল (১৪)। খবর বিডিনিউজ।
ম্যাচের লাগাম তখন বাংলাদেশের হাতে। আস্তে আস্তে তা নিজেদের হাতে নিতে শুরু করেন শ্রেয়াস আইয়ার ও আকসার প্যাটেল। চাপকে পাত্তা না দিয়ে দারুণ খেলে রান বাড়াতে থাকেন দুজন। ধীরে ধীরে গ্যালারির আওয়াজ কমে আসতে থাকে। দুজনের জুটি পেরিয়ে যায় শতরান।
বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা এই জুটি ভাঙেন সেই মিরাজ। তাকে একটি ছক্কা মারার পর আরেকটির চেষ্টা করতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন ৮২ রান করা শ্রেয়াস। শেষ হয় ১০১ বলে ১০৭ রানের জুটি।
আরেক প্রান্তে আকসার তিন ছক্কায় পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলেন সমান বল খেলে। তাকে ফেরাতে ইবাদতকে আক্রমণে ফেরান লিটন। ফলও মেলে হাতেনাতে। ৫৬ রানে বিদায় নেন আকসার।
ম্যাচ তখন বাংলাদেশের মুঠোয় বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে ব্যান্ডেজ নিয়ে গ্লাভস কেটে ব্যাটিংয়ে নামেন রোহিত। শুরুতে একটু সময় নেন। এরপর তোলেন ঝড়।
শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চের জোয়ারে ভেসে ম্যাচের ফয়সালা হয় শেষ বলে। ৫ ছক্কায় ২৮ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলেও হতাশায় মাঠ ছাড়েন রোহিত। স্নায়ুর লড়াইয়ে জিতে সিরিজ জয়ের আনন্দে ভাসে বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৭১/৭ (এনামুল ১১, লিটন ৭, শান্ত ২১, সাকিব ৮, মুশফিক ১২, মাহমুদউল্লাহ ১৪, আফিফ ৬, মিরাজ ১০০*, নাসুম ১৮*; চাহার ৩-০-১২-০, সিরাজ ১০-০-৭৩-২, শার্দুল ১০-১-৪৭-০, উমরান ১০-২-৫৮-২, ওয়াশিংটন ১০-০-৩৭-৩, আকসার ৭-০-৪০-০)।
ভারত: ৫০ ওভারে ওভারে ২৬৬/৯ (কোহলি ৫, ধাওয়ান ৮, শ্রেয়াস ৮২, ওয়াশিংটন ১১, রাহুল ১৪, আকসার ৫৬, শার্দুল ৭, চাহার ১১, রোহিত ৫১*, সিরাজ ২, উমরান ০*; মিরাজ ৬.১-০-৪৬-২, ইবাদত ১০-০-৪৫-৩, মুস্তাফিজুর ০-০-০-০, নাসুম ১০-০-৫৪-০, সাকিব ১০-১-৩৯-২, মাহমুদউল্লাহ ৩.৫-০-৩৩-১)
ফল: বাংলাদেশ ৫ রানে জয়ী। সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে এগিয়ে। ম্যান অব দা ম্যাচ: মেহেদী হাসান মিরাজ।
টাইগারদের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের একদিনের আন্তর্জাতিক (ওডিআই) সিরিজে এক ম্যাচ হাতে রেখে ২-০ ব্যবধানে জয়ের জন্য জাতীয় ক্রিকেট দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছন।
স্বাগতিক বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে এক উইকেটে এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ৫ রানে জিতেছে। এক অভিনন্দন বার্তায়, ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী ভারতকে হারানোর জন্য জাতীয় ক্রিকেট দলের সকল খেলোয়াড়, কোচ এবং কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কর্মকর্তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয়ের ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।