সুপ্রভাত ডেস্ক »
চার বলে ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন ১ রান। বাংলাদেশের দরকার ১ উইকেট। মারুফা আক্তারের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিলেন মেঘনা সিং। বল আশ্রয় নিল কিপারের গ্লাভসে। আউটের সিদ্ধান্ত পাওয়ার আগেই উদযাপন শুরু করলেন কিপার নিগার সুলতানা। পরে আঙুল তুললেন আম্পায়ার। মেঘনা তাতে অবাক। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ওসব দেখার সময় কোথায়! তারা মেতে উঠল অবিশ্বাস্যভাবে পরাজয় এড়ানোর বাঁধনহারা উল্লাসে।
আইসিসি উইমেন’স চ্যাম্পিয়নশিপের সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচটি হারের দুয়ার থেকে ‘টাই’ করল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ৪ উইকেটে হারিয়ে করা ২২৫ রানের জবাবে ভারত গুটিয়ে গেল সমান স্কোরেই।
ম্যাচ একসময় ছিল ভারতের প্রায় মুঠোয়। কিন্তু স্রেফ ৩৪ রানে শেষের ৬ উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। সিরিজ শেষ হলো ১-১ সমতায়। ৮ বলে যখন প্রয়োজন ৮ রান, মেঘনার বাউন্ডারিতে ম্যাচ অনেকটা হেলে পড়ে ভারতের দিকে। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৩ রানের। মারুফা আক্তারের প্রথম দুই বলে একটি করে রান নেন মেঘনা ও জেমিমা রদ্রিগেস। পরের বলেই মেঘনার বিদায়ে নাটকীয় সমাপ্তি।
মেয়েদের ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম ‘টাই’ এটি। সব মিলিয়ে এই সংস্করণে ‘টাই’ হওয়ার নবম ঘটনা ম্যাচটি।
আইসিসি উইমেন’স চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত এই সিরিজের তিন ম্যাচ থেকে দুই দলই পেল সমান ৩টি করে পয়েন্ট। ৯ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের সাতে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সমান ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষেই আছে ভারত। খবর বিডিনিউজ।
এদিন ইতিহাসের অংশ হয়েছেন ফারজানা হক। এই সংস্করণে দেশের প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন অভিজ্ঞ ব্যাটার। ১৬০ বলের ম্যারাথন ইনিংসে ৭ চারে তিনি করেছেন ১০৭ রান।সেঞ্চুরির আগের দুই ম্যাচে ২৭ ও ৪৭ রানের ইনিংস খেলার সৌজন্যে সিরিজ সেরার পুরস্কার জেতেন ফারজানাই। তবে শেষ ম্যাচের সেরার স্বীকৃতি পাননি তিনি। ৭৭ রানের ইনিংসে ভারতকে জয়ের আশা দেখানো হার্লিন দেওলের হাতে ওঠে পুরস্কারটি। ম্যাচে জোড়া পরিবর্তন নিয়ে খেলতে নামে বাংলাদেশ। দুই ওপেনার বদলের সুফল পায় তারা। শারমিন আক্তার ও মুর্শিদা খাতুনের জায়গায় ইনিংস সূচনার সুযোগ পেয়ে ৯৩ রানের জুটি গড়েন ফারজানা ও শামিমা সুলতানা।
বড় জুটি গড়লেও রানের গতি বাড়াতে পারেননি দুই ওপেনার। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি ছুঁয়ে ২৭তম ওভারে শামিমা আউট হন ৭৮ বলে ৫২ রান করে। ফারজানার নামের পাশে তখন ৮০ বলে ৩১ রান। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে রানের পালে হাওয়া লাগে। নিগার ও ফারজানা মিলে ৮৫ বলে যোগ করেন ৭১ রান। যেখানে অগ্রণী ভূমিকা ফারজানার। শামিমার বিদায়ের পর হাত খোলেন তিনি। দশম ফিফটি ছুঁতে তিনি খেলেন ৯৭ বল।
স্নেহ রানার বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ আউট হন নিগার। ১ চারে ৩৬ বলে তিনি করেন ২৪ রান। রিতু মনি পারেননি বেশিক্ষণ টিকতে। ফিফটি ছোঁয়ার পর রানের গতি আরও বাড়ান ফারজানা। চতুর্থ উইকেটে তাকে দারুণ সঙ্গ দেন এই ম্যাচ দিয়ে একাদশে ফেরা সোবহানা মোস্তারি। স্রেফ ৪৫ বলে আসে এই জুটির পঞ্চাশ রান। ওয়ানডেতে এবারই প্রথম কোনো ম্যাচে তিনটি পঞ্চাশ ছোঁয়া জুটি পেল বাংলাদেশ। এর আগে সাতটি ভিন্ন ম্যাচে দেখা গেছে দুইটি পঞ্চাশ ছোঁয়া জুটি। ৪৮তম ওভারে শেফালির বলে দারুণ কাভার ড্রাইভ বাউন্ডারিতে স্বপ্নের সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ফারজানা। ইনিংসের শেষ বলে রানআউটে থামে তার ম্যারাথন ইনিংস। সোবহানা অপরাজিত থাকেন ২ চারে ২২ বলে ২৩ রান করে। ভারতের পক্ষে ২ উইকেট নেন স্নেহ রানা। দেভিকা বৈদ্যর শিকার একটি। রান তাড়ায় ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ফিরতে পারতেন স্মৃতি মান্ধানা। মারুফার প্রথম বলে কাট করতে গিয়ে তার ব্যাটের বাইরের কানা ছুঁয়ে বল যায় উইকেটের পেছনে। সহজ ক্যাচ নিতে পারেননি নিগার।
ওই ওভারে অবশ্য সাফল্য ঠিকই আদায় করে নেন মারুফা। পঞ্চম বলে ড্রাইভ করার চেষ্টায় ফিরতি ক্যাচ দেন শেফালি ভার্মা। সিরিজে প্রথমবার সুযোগ পেয়ে স্রেফ ৪ রানে থামেন তরুণ ওপেনার। তিন নম্বরে নামা ইয়াস্তিকা ভাটিয়াকে এলবিডব্লিউ করেন সুলতানা খাতুন। পাঁচ ওভারের মধ্যে দুই উইকেট হারানো দলকে পথে ফেরান স্মৃতি ও হার্লিন। ১০৭ রানের জুটি গড়েন তারা। ক্যারিয়ারের ২৬তম ফিফটি ছুঁয়ে ইনিংস আর বড় করতে পারেননি স্মৃতি। ফাহিমা খাতুনের বলে কাট করতে গিয়ে সোবহানার হাতে তিনি ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৫৯ রানে। বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি হারমানপ্রিত কৌরও। নাহিদা আক্তারের ফুল লেংথ ডেলিভারি সুইপ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হন ভারত অধিনায়ক। বল তার ব্যাট-প্যাড হয়ে জমা পড়ে স্লিপে ফাহিমার হাতে। জোরাল আবেদনে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি হারমানপ্রিতের। আম্পায়ারের দিকে আগুনে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ব্যাট দিয়ে তীব্র আক্রোশে আঘাত করেন স্টাম্পে। অসন্তোষ নিয়ে মাঠ ছাড়ার সময় গ্যালারির দর্শকদের দিকে ‘থামস আপ’ দেখান তিনি।
কিছুক্ষণ পর নামে বৃষ্টি। প্রায় ৪০ মিনিট বন্ধ থাকে খেলা। পুনরায় খেলা শুরুর পর প্রথম ওভারে ফাহিমার বলে ডিপ মিড উইকেটে হার্লিনের ক্যাচ ছাড়েন লতা ম-ল।
পরে দারুণ ফিল্ডিংয়ে ফাহিমাই ফেরান হার্লিনকে। নাহিদার বল পয়েন্টের দিকে ড্রাইভ করে রানের জন্য ছোটেন ব্যাটার। ডানে ঝাঁপিয়ে ত্রিশ গজের বৃত্তেই বল থামান ফাহিমা। তা দেখে হার্লিনকে ফিরিয়ে দেন জেমিমা রদ্রিগেজ। অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়া হার্লিন আর ক্রিজে ফিরতে পারেননি। ফাহিমার নিখুঁত থ্রো ধরে স্টাম্প ভেঙে দেন নিগার। শেষ হয় হার্লিনের ৯ চারে সাজানো ১০৮ বলের ইনিংস। ওই ওভারেই আরেকটি ধাক্কা খায় ভারত। শেষ বলটি কাভারের দিকে ঠেলে রানের জন্য ছোটেন জেমিমা। এবার সরাসরি থ্রোয়ে স্ট্রাইক প্রান্তে দিপ্তি শর্মাকে রান আউট করেন সোবহানা।
এক ওভার পর সুলতানা খাতুনের বলে শর্ট মিড উইকেটে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন জেমিমা। কিন্তু লাফ দিতে টাইমিংয়ের গড়বড়ে সেটি হাতে নিতে পারেননি রিতু মনি।
জীবন পেয়ে জেমিমা বাঁচিয়ে রাখেন ভারতের আশার প্রদীপ। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন আমানজত কৌর। দুজন মিলে ৩০ বলে করেন ২৪ রান। জয়ের খুব কাছে চলে যায় সফরকারীরা।
আমানজতকে এলবিডব্লিউ করে জুটি ভাঙেন রাবেয়া খান, নতুন করে আশা জাগে বাংলাদেশের। পরের ওভারে জোড়া আঘাত হানেন নাহিদা। ম্যাচের পাল্লা হেলে পড়ে বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু শেষ ব্যাটার মেঘনার চারে ফের জাগে তাদের হারের শঙ্কা। সেই শঙ্কা ছাপিয়েই আনন্দচিত্তে মাঠ ছাড়ল বাংলাদেশ দল। শেষ পর্যন্ত ৩৩ রানে অপরাজিত থাকেন দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতের জয়ের কারিগর জেমিমা।বাঁহাতি স্পিনে ৩টি উইকেট নেন নাহিদা। মারুফার শিকার ২টি।