মো. মোরশেদুল আলম :
ভাষা আন্দোলন (১৯৫২ খ্রি.) ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি ও শোষণ-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। এ আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এলিটদের মধ্যে এক প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের সূচনা করে। বাংলা ভাষার উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ চক্রের আক্রমণ ছিল মূলত বাঙালি জাতির আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হাজার বছরের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত।আর্যদের ভাষা যেমন বাংলা ছিল না, মধ্যযুগে মুসলমান শাসক কিংবা আধুনিক যুগে ইংরেজ শাসকদের ভাষাও তেমনি বাংলা ছিল না। আর্যদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। মুসলমান শাসকদের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফারসি। আর আধুনিক যুগে ব্রিটিশ শাসনামলে দাপ্তরিক ভাষা ছিল ইংরেজি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো শাসনামলেই বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পায়নি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, দেশে ব্রিটিশ শাসন জমাট হয়ে উঠার ধাপে ধাপে ক্রমে সংস্কৃত-আরবি-আশ্রিত আবহমান বিদ্যাচর্চার ধারা অবসিত, তাৎপর্যহীন হয়ে গেল।বাংলা ভাষার প্রতি এমন অবহেলা লক্ষ করে ষোড়শ শতকের কবি আবদুল হাকিম লিখেছেন, যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়, নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে “পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা” শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এক নিবন্ধে লেখেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। যা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক কিংবা টুপি দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত কৃষ্টি পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে।…উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীর মরণÑরাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয়ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব-পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র, যেমন ভারত ছিল ইংরেজি রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র। ফলে পূর্ববাংলার শিক্ষিত সমাজ এবং ছাত্রসমাজের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও বাংলা ভাষার দাবিকে জোরদার করা হয়।
তমদ্দুন মজলিস ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু? শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এতে অধ্যাপক আবুল কাশেম লেখেন, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যেমন জনগণের মত না নিয়ে ইংরেজিকে জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল-শুধু উর্দু কিংবা বাংলাকে সমস্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে ঠিক সেই সাম্রাজ্যবাদী অযৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে কংগ্রেসদলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা করার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাঁরএ বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। খাজা নাজিমুদ্দীনও লিয়াকত আলী খানের সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, পূর্ববাংলার জনগণ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চায়। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের ৫৪.৬ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী এবং মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষ উর্দুভাষী। পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলের মোট সাতটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মাতৃভাষা এবং অন্য ছয়টি ভাষায় অর্ধেকেরও কম মানুষ কথা বলে। কিš‘ সমাজ ও রাজনীতির মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকমহল ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির উপর নগ্নভাবে আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এ ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
নুরুল আমিন সরকার ছাত্র আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল প্রকার মিছিল ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে। পুলিশ এক পর্যায়ে মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ অনেকে শহিদ হন।
মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহিদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার নির্মাণে দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র সহযোগিতা করেন। শহিদ শফিউর রহমানের পিতা ২৪ তারিখে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। কিš‘ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ উক্ত শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেয়। পরিশেষে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনু”েছদে উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার প্রশ্নে সর্বদাই আপসহীন ছিলেন। অসমাপ্ত আতœজীবনী গ্রšে’ তিনি লেখেন, “বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুুও আমরা বাংলা এবং উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম।” তিনি আরো বলেন, “দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে…। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেয়া যাবে ভেবেছিল, কিš‘ পারে নাই। যেকোন জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোন জাতিই কোন কালে সহ্য করে নাই।”
ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন। এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে বিনাবিচারে বঙ্গবন্ধুকে দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জেলে বন্দি থাকা অব¯’ায় বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর পূর্ববাংলায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই ১৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে শামসুদ্দোহাসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে দেখা হয়। এসময় বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, “যেন একুশে ফেব্রুয়ারীতে হরতাল মিছিল শেষে আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়।”
স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন।অথচ পরিতাপের বিষয় হ”েছ এখনও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারে উদাসীনতা লক্ষণীয়। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে, তবুও সর্বত্র এ ভাষার ব্যবহারে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের২৯তমঅধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন, যা ছিল বিশ্বসভায় কোনো বাঙালি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের প্রথম বাংলায় ভাষণ। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলা ভাষা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা অর্জন করে। জাতিসংঘভুক্ত দেশসমূহ তখন থেকেই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। পৃথিবীর কোথাও ভাষার নামে দেশ নেই। কিš‘ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার নামে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা একই সাথে ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। অথচ এখনো উ”চ আদালত, চিকিৎসা-প্রকৌশলবিদ্যাসহ উ”চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত। অথচ এ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু দুই বছরেরও অধিক সময় জেলে বন্দি ছিলেন, জেলখানায় অনশন করেছেন, ভাষা শহিদরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, অনেকেই পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন, অনেকেই কারাজীবন ভোগ করেছেন। তাই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়