রসগোল্লা উৎসব

খোবাইব হামদান :

মিনু আপা শহর থেকে গতকাল এসেছে। রবিন, ঝুমা ও রুমাদের স্কুল বন্ধ হলো আজ। হামেদ ও রানুদের স্কুল আগামীকাল বন্ধ হবে। রবিন, ঝুমা ও রুমা তিন ভাইবোন বাবা-মায়ের সাথে নন্দপুর গ্রামে থাকে। রবিন পঞ্চম, ঝুমা তৃতীয় ও রুমা প্রথম  শ্রেণিতে পড়ে। হামেদ ও রানু তাদের খালাতো ভাইবোন। তাদের বসবাস শহরে। রানু তৃতীয় শ্রেণি ও হামেদের সবেমাত্র পে¬তে পড়া শুরু। সবাই গ্রীষ্মকালীন ছুটি পাওয়ায় নানার বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা এঁকেছে। সবাইকে দেখাতে রবিন নিল তার লেখা ছোট্ট ছড়ার খাতা, ঝুমা ও রুমা তাদের আঁকিবুঁকির খাতা। ঐদিকে রানু নিয়ে আসল তার নতুন নতুন গল্পছড়ার বইয়ের সংগ্রহ। সবাই নানার বাড়িতে একত্রিত হয়ে নানা-নানিকে সালাম করে হৈ-হুল্লোড় জুড়ে দিল। সাথে যুক্ত হলো মামাতো ভাই রাশেদ। রাশেদ রবিনের ক্লাসমেট। মিনু আপার সাথে কথা বলে ঠিক করা হলো বিকেলবেলা সবাই নানার বাড়ির লিচুবাগানে যাবে। সেখানে করা হবে রসগোলা উৎসব। রসগোল¬া উৎসবে থাকে ছোটখাটো পিকনিক, ছড়াপাঠ, গল্প, বইপ্রদর্শন, ধাঁধা ও আরও কতো কী!

দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই বিকেলবেলার অপেক্ষা করতে লাগল। মিনু আপা ঘুমাতে গেলেও এদের চোখে এলো না ঘুম। হামেদ রানুকে কিছুক্ষণ পরপরই জিগ্যেস করে, আপু আর কতক্ষণ?  রানু ডিব্বাডিব্বা চোখে এদিক-সেদিক দেখে চুপ করে রয়।

হঠাৎ এলো মিনু আপার ডাক, নিতে বলা হলো প্রস্তুতি। রাশেদ ও রবিন একটা মাদুর ও দুইটা পাত্র নিলো। রানু নিলো বই, রুমা ও ঝুমা আঁকিবুঁকির খাতা। রাশেদ নিলো তেলেভাজা চিড়ামুড়ি, ভাঙা বাদাম ও কাঁচা আমের মজার চাটনি। সবাই একসাথে রওয়ানা হলো লিচুবাগানের উদ্দেশে। লিচুবাগানে লিচুগাছে ঝুলছে কাঁচা লিচু, এখনো মিষ্টি হয়নি। তবুও রবিন ও রাশেদ দুইটা লিচু খেয়ে নিলো, যদিও মুখের ধরন পাল্টে গেল অতিরিক্ত খাট্টা হওয়ায়। বড় লিচু গাছটির নিচে পাতা হলো মাদুর। গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসলেন মিনু আপা, সবাই যথাক্রমে গোল করে বসে পড়লো।

বিকেলবেলা ঠিক সময়ে শুরু হলো রসগোল¬া উৎসব। শুরুতেই এলো ধাঁধার ব্যাপার। রাশেদের ধাঁধা ভাঙতে পারে কে? রাশেদ একেকটা ধাঁধা বলে যায়, কেউ না পেরে মিনু আপার দিকে তাকায়। মিনু আপাও মাঝে-মাঝে চুপ হয়ে, বলে, তোরা বল। রবিন ও রানুও কয়েকটি ধাঁধা জিগ্যেস করে। কেউ বলতে না পারলে নিজেই বলে দেয়।

এরপরে শুরু হলো ছড়াপাঠ। রবিন সর্বপ্রথম পাঠ করলো কাজী নজরুল ইসলামের লিচুচোর ছড়াটি। তার সুরে সুরে পড়তে লাগল মিনু আপা, রাশেদ ও ঝুমারাও।

 

‘আমিও বাগিয়ে থাপড়

দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়

লাফিয়ে ডিঙনু  দেয়াল

দেখি এক ভিটরে শেয়াল!

তৌবা-নাক খপ্তা …

রাশেদ পাঠ করলো রবীন্দ্রনাথের, ‘আষাঢ়’ কবিতা :

 

‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।

ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে …।

 

এরপরই রুমা বলে উঠলো,

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি,

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।”

 

এর মাঝে মিনু আপা বললেন, রবীন্দ্রনাথের আমি একটা মজার ছড়া শুনাই, ‘ক্ষান্তবুড়ির দিদি শাশুড়ি’ :

ক্ষান্তবুড়ির দিদি শাশুড়ির পাঁচবোন থাকে কালনায়,

শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায় হাঁড়িগুলো রাখে আলনায় …

 

সবার কণ্ঠে হো হো হাসির শব্দ শুরু হয়। রবিন, মিনু আপাকে বললো, আপা হারাধনের দশটি ছেলে শুনাও। মিনু আপা বললো, ঠিকাছে শুনাবো। তবে শর্ত হচ্ছে, তোমার লেখা কচি ছড়াগুলো আমাদের শুনাতে হবে। রবিনকে সবাই কাতুকুতু দিয়ে খোঁচাতে লাগলো। জোড়াজুড়ি জুড়ে রবিন পড়া শুরু করল নিজের লেখা  ছোট ছোট ছড়াগুলো। ছড়ার নাম ‘বৃষ্টি’। লিখেছেন …বলে মুচকি হাসি দিয়ে মিনু আপার দিকে তাকালে সবাই হো হো করে হাসতে লাগলো। মিনু আপা বললো, লিখেছেন আমাদের রবিন সাহেব। এবার শুরু হোক তবে,

‘বৃষ্টি পড়ে টুপুর টাপুর ঝিনঝিনা ঝিন ছন্দ,

বৃষ্টি দেখে কদমফুলটি ছড়িয়ে দিল গন্ধ …

এভাবে রবিন বেশ কয়েকটি ছড়াপাঠ করে। রুমা, ঝুমা, রুনা ও রাশেদ হাসতে হাসতে হয়রান। মিনু আপা তাদের হাসি বন্ধ করে রবিনকে ভালো ভালো ছড়াকারের বই পড়ার পরামর্শ দিল। এবং পরের বার শহর থেকে আসার সময় জনি হোসেন কাব্যের ছড়ামর্শ বইটি নিয়ে আসবে বললে রবিন আনন্দে টুকটুকে লাল হয়ে উঠলো। সুকুমার রায়, সুকুমার বড়ুয়া, জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদের ছড়া কবিতা পড়তে পড়তে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। সূর্যটা ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠলো। এবার আঁকিবুকি দেখানোর পালা। রুমা দেখালো তার আঁকাঘরটি।

হামেদ দেখালো তার আঁকা নৌকা, আম ও ছাগলটা। ছাগলের এক পা না থাকায় আবার পড়লো হাসির ঢেউ। ঝুমা দেখালো শহিদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ও আমাদের গ্রাম ছবি। সবাই ঝুমার প্রশংসা করলো।

রুনা ছবি আঁকতে পারে না তাই সে নিজের সংগৃহীত নতুন বইগুলো সবাইকে দেখাতে শুরু করলো। তার কাছে বই বেশি থাকায় সবাইকে সে একটা একটা বই পড়তে দিলো। তবে শর্ত হলো, নানার বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে আগে তাকে বই ফেরত দিতে হবে। ধাঁধা, ছড়াপাঠ, আঁকিবুকি ও বই নিয়ে হইচই করতে করতে খাওয়ার কথা সবাই ভুলেই গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় মিনু আপা তাড়াতাড়ি করতে বললে, সবাই  গোল করে বসে চিড়া-মুড়ি ভাজা, ভাঙা বাদাম ও কাঁচা আমের চাটনি খেতে লাগলো। হামেদ ভাঙা বাদামের কয়েকটি পকেটে ঢুকাতে দেখে রুমার সাথে শুরু হইচই-রইরই ঝগড়া।

শেষ হয় রসগোল¬া উৎসব। অন্ধকার হওয়ার আগেই সবাই ফিরে যায় নানার বাড়িতে।