মোহীত উল আলম »
আমার মা আমাদের কোথাও যাওয়া অর্থহীন বা অপ্রয়োজনীয় মনে করলে বলতেন, ওখানে কি কলা পেকেছে? এ কথাটা অনেকটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণের অনুরূপ। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ২৪ মে ২০২৩ ঘোষিত বাংলাদেশের ওপর প্রয়োগকৃত থ্রি সি ভিসানীতির প্রতিক্রিয়ায় তিনি জোরগলায় বলেছেন আমেরিকার ভিসার দরকার নেই, আমেরিকায় না গেলে কী হয়? প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিক্রিয়া ভারত সহ বিভিন্ন দেশের বহু চ্যানেলে উৎকলিত সংবাদ হিসেবে ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছে। এই ভিসানীতিতে আছে যে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বা নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যে সব ব্যক্তিকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করেছে বা করছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতীয়মান হবে, সে সব ব্যক্তিবর্গকে যুক্তরাষ্ট ভ্রমণে বা গমনে ইচ্ছুক হলে তাদেরকে ভিসা দেবে না।
এমনিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কোন দেশ ভিসা দিল বা দিল না তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করা যাচ্ছে যে এর পর থেকেই যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি চারিত্রিক পরিবর্তন এসেছে। অন্তত পত্র-পত্রিকাগুলোর খবর প্রদান ও টিভির চ্যানেলগুলোতে সংবাদ ও সংবাদচিত্রের পরিবেশনা থেকে বুঝতে পারি গণতান্ত্রিক পরিবেশে সহমতের পরিসর পূর্বের চেয়ে অনেকটুকু বেড়েছে।
তা হলে কী এমন কার্যকারিতা এই মার্কিনী থ্রি সি ভিসার? বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেবল যদি রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকতো, যেমন ধরুন আফ্রিকার বা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কেবলই রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে তা হলে এ কথাটা মান্য হতো। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং সহজ ও জটিল উভয় মাত্রারই সম্পর্ক। আমাদের বস্ত্র খাতে মার্কিনী ব্যবসায়ীরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ক্রেতা। আরও কিছু পণ্যের জন্য আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল। সম্ভবত ভারতের পরে, কিংবা জাপানের পরে আমাদের অর্থনীতির বড় বিনিয়োগীরা হলো মার্কিনী বিভিন্ন সংস্থা। অভিবাসনের দিক থেকে দেখলে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী বাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ভারতের পরে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পড়তে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আবার মার্কিনীদেরও বাংলাদেশে অর্থ লগ্নি করার বহু সুযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সব বিবেচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি মেকারদের মনে কাজ করেছে নিশ্চয় যখন তারা থ্রিসি ভিসা প্রবর্তন করে।
মার্কিনীরা বাংলাদেশের নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ দেখতে চাইলে বাধ্যতামূলকভাবে অর্থনৈতিক স্যাংশন দিতে পারতো, বলতে পারতো যে তাদের আজ্ঞাবাহী আই এম এফ এবং বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেবে না, বলতে পারতো যে রোহিঙ্গা সমস্যা যাতে আরও বৃদ্ধি পায় আন্তর্জাতিকভাবে সেটা নিয়ে তারা চাপ প্রয়োগ করবে, কিংবা বলতে পারতো যে মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে না, কিংবা যে রীতিতে তারা ১৯৭৪ সালে সমাজতন্ত্রী দল কিউবায় পাট রপ্তানি করার দায়ে বাংলাদেশকে শাস্তি স্বরূপ পিএল ৪৮০-র খপ্পরে ফেলেছিল, এবং দুর্ভিক্ষের সময় কোন একটি দেশ (সম্ভবত কিউবা) থেকে আসা গমের জাহাজও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির চাপে, সেরকম কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা তারা বলেনি। কিংবা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের অংশগ্রহণ, যেটি বিরাট একটি উপার্জনের রাস্তা, সেটাতেও বাধা দিতে পারতো। অর্থাৎ, যে কোন কিছুর ওপর তারা স্যাংশন দিতে পারতো। কিন্তু তারা শুধু দিল ভিসার ওপরে। কতজন বাংলাদেশি প্রতি বছর মার্কিনী ভিসার জন্য আবেদন করে আমি জানি না, কিন্তু সংখ্যা যাই হোক আঠারো কোটির লোকের দেশে মার্কিনী এই ভিসানীতি সমুদ্রে লোষ্ট্রনিক্ষেপের চেয়ে অকিঞ্চিতকর। কিন্তু কেন তারপরও তারা এই ভিসানীতির পলিসিটা নিল?
এখানে আমি ব্যাখ্যাটা দিচ্ছি, ড্যানিয়েল লার্নার নামক খুব নামকরা একজন সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রাচ্যবিদ ১৯৫৮ সালে একটি চিন্তা উদ্রেককারী বই লিখলেন: “দ্য পাসিং অব ট্র্যাডিশনাল সোসাইটি”। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির আধুনিকায়ন নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি এই বইতে বললেন যে পশ্চিম ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো তাদের শারীরিক বলিষ্ঠতা ও উন্নততর বুদ্ধির জন্য পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে সা¤্রাজ্য স্থাপন করতে পেরেছে বিজাতীয় সংস্কৃতি ও দেশের ওপর। অর্থাৎ, লার্নারের মতে নৃতাত্ত্বিকভাবে পশ্চিম ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর চেয়ে উন্নততর বলেই সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
এই যুক্তিকে সম্পূর্ণ খ-ন করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক নব্য ইতিহাসবাদের প্রবর্তক এবং বিশ্বখ্যাত শেক্সপিয়ার প-িত স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট তাঁর “দ্য ইম্প্রোভাইজেশন অব পাওয়ার” (১৯৮০) প্রবন্ধে বললেন যে পশ্চিম ইউরোপের সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কর্তৃত্ব কোন নৃতাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত শারীরিক সবলতার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরঞ্চ হয়েছে তাদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্ন বা তাৎক্ষণিক প্রায়োগিক কৌশলের জন্য। তিনি বিশেষ করে দুটো উদাহরণ দিলেন। একটি ইতিহাস থেকে আরেকটি সাহিত্য থেকে।
ইতিহাস থেকে তিনি বললেন কলম্বাসের চতুর্থ সমুদ্রযাত্রার কথা। ১৪৯৩। এর মধ্যে নেইটিভ ইন্ডিয়ানরা কলম্বাসের চালচলন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। তারা মনে করছে, কলম্বাস বোধ হয় তার সহগামী নাবিকদের নিয়ে স্থায়ীভাবে গোড়াপত্তন করবেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল যে কলম্বাস এবং তার লোকদেরকে আর খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হবে না। এদিকে কলম্বাস তাঁর দূরবীণ দিয়ে দেখতে পেলেন যে দিগন্তে কালো মেঘের সঞ্চার হচ্ছে এবং আগামী তিনদিনের মাথায় এটি প্রচ- ঝড়ে রূপ নিয়ে উপকূলে আঘাত হানবে। তখন কলম্বাস নেইটিভ গোত্রদের প্রধানকে ডেকে নিজের হাতের বাইবেলটি দেখিয়ে বললেন যে এই যে আমার হাতে দেখতে পাচ্ছো, এটি ঈশ্বরের পবিত্র গ্রন্থ। এবং আমরা হচ্ছি তাঁর লোক। অমুক পৃষ্ঠায় দেখ লেখা আছে যে তোমরা যদি আমাদেরকে খাদ্যশস্য সরবরাহ না করো, তা হলে তিনদিনের মাথায় এমন ঝড় উঠবে যে তোমাদের শস্য মাঠে লুটিয়ে পড়বে। দলনেতা কিছুই বিশ্বাস না করে ভেংচি কেটে চলে গেলেন। আর তিনদিনের মাথায় ঠিকই ঝড় উঠল আর রেড ইন্ডিয়ানদের গমের শষ্য লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তখন তারা দলে দলে এসে কলম্বাসের বাইবেলকে খুব মান্য করতে লাগলো। কলম্বাস আর তার দলের খাদ্যশস্যের আর অভাব রইলো না। গ্রিনব্ল্যাটের মতে কলম্বাস এখানে যে চাতুর্যপূর্ণ কাজটি করলেন সেটি হলো তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন বিজ্ঞানের উপাদান দূরবীন দিয়ে, কিন্তু আদিম লোকগুলোকে আশ্বস্ত করল ধর্মগ্রন্থ দেখিয়ে। এটাই হলো মার্কিনী ভিসানীতির সমপর্যায়ের চাল। অর্থাৎ যে তরিকা দিলে এই লোকগুলোকে বশ করা যাবে।
বলাবাহুল্য এই ধারার রাজনৈতিক কূটচালের অন্যতম ব্যাখ্যাদানকারী ম্যাকিয়াভেলীর অনুসরণে গ্রিনব্ল্যাট এবার সাহিত্য থেকে একটি উদাহরণ টানলেন। শেক্সপিয়ারের “ওথেলো” নাটকে মধ্যবয়সী কৃষ্ণাঙ্গ ওথেলো বিয়ে করে বসল শ্বেতাঙ্গ অনূঢ়া রমণী ভেনিস নিবাসী ডেসডিমোনাকে। এদিকে ইয়াগোকে চাকরিতে পদোন্নতি না দেওয়ায়, এবং তার অধস্তন ক্যাসিওকে তার ওপরে পদোন্নতি দেওয়ায়, ইয়াগো পণ করল সে এ বিয়েটা ভাঙবেই। তখন, গ্রিনব্ল্যাটের মতে, শ্বেতাঙ্গ ইয়াগো একটা প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্ন চাল দিল। অর্থাৎ সে ততক্ষণাৎ ভেবে বের করল যে এ বিয়েটাকে সে ধ্বংস করতে পারে দ্বিতীয় বাছাইয়ের চাল চেলে। দ্বিতীয় বাছাইটা কী? ইয়াগো ওথেলোর একান্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে তার কানে ফুসলিয়ে বলল যে যে লক্ষ্মী কিশোরী ডেসডিমোনা এতগুলো ভেনিসীয় যুবকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তার বাপকে ত্যাগ করে, তার নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি ত্যাগ করে ওথেলোর মতো কালো, বয়স্ক, পেটমোটাওয়ালা লোককে বিয়ে করতে পারে, সে সহসা তার ভুল বুঝতে পারবে, এবং দ্বিতীয় বাছাই বা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের দিকে যাবে। এবং ম্যাকিয়াভেলীর সূত্র অনুযায়ী ইয়াগো নতুন যে ত্রিকোণী ভালোবাসার সম্পর্কটা দাঁড় করালো, তাতে এক দিকে রইলো ওথেলো, অন্যদিকে রইলো ডেসডিমোনা, এবং তৃতীয় পয়েন্টে দাঁড় করালো ক্যাসিওকে। এবং ওথেলোকে বোঝালো, মাই লর্ড, আপনিতো ভেনিসে বহিরাগত, আপনি আমাদের মেয়েদের চেনেন না। এরা ঈশ্বরকে ভয় পায় না, কিন্তু স্বামীকে ভয় পায়। তাই স্বামীর আড়ালে তারা পরপুরুষের সঙ্গে যৌনতা করে। এবং বলে যে তার দৃঢ় সন্দেহ ডেসডিমোনা ওথেলোর ওপর বিরক্ত হয়ে নিশ্চয় ক্যাসিওর সঙ্গে যৌনাচার করছে গোপনে। ওথেলো সে সন্দেহ থেকে ডেসডিমোনাকে গলা টিপে হত্যাই করে ফেলে। এখানে, গ্রিনব্লাটের মতে, ইয়াগো তার প্রত্যুৎপন্ন বুদ্ধি দিয়ে যে কাজটি সমাধা করল, সেটি হলো যে ওথেলোর মধ্যে এ সন্দেহের বীজ সফলভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ অন্য কোন চাল না ভেবে দাবার মোক্ষম চালটি ইয়াগো তৈরি করল একটা চিরন্তন সাহিত্যিক উপাদান দিয়ে: পুরুষমানুষের ঈর্ষাকাতর যৌনতাবোধ। ইয়াগোর হাতে ওথেলোর পতন প্রতীকী অর্থে লর্ড ক্লাইভের কাছে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার পতন, ইংল্যান্ডের কাছে ভারতের পরাধীন হওয়া এবং মার্কিনী নতুন থ্রি সি ভিসানীতির ফলে বাংলাদেশে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠা। কারণ কী?
কারণ হলো, রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা এ মুহূর্তে স্বয়ং রাজনৈতিকদের মধ্যে ক্লিয়ার নয়, কাকে যে কখন দেশ ছাড়তে হতে পারে এবং আমেরিকায় দৌড়াতে হতে পারে, সে জন্যই এই উৎকন্ঠা। এই উৎকণ্ঠাকে পুঁজি করেই মার্কিনী এই ভিসানীতির প্রবর্তন। এটিই এদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্ন চাল। দাবাখেলার ভাষায়, দ্য মেইটিং মুভ।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক