মৎস্যকন্যার বন্ধুরা

ওবায়দুল সমীর »

গভীর সাগরের নিচে এক সুন্দর রাজ্য ছিল। যেখানে থাকত এক ছোট্ট মৎস্যকন্যা। তার নাম নীলা। নীলার লেজ ছিল ঝলমলে নীল-সবুজ, আর তার চোখ দুটি ছিল টলটলে জলের মতো। তার নীল-সবুজ ঝলমলে লেজ আর মুক্তোর মতো উজ্জ্বল চোখ দেখে সবাই বলত,
‘নীলা, তুমি তো ঠিক মুক্তোর পরি!’
নীলা ছোটবেলা থেকেই সাগরের রঙিন প্রবাল, ছোট মাছ আর ঝিনুকের সঙ্গে খেলে বড় হচ্ছিল। নীলা ছিল খুবই কৌতূহলী সে সবসময় হাসিখুশি থাকত। বান্ধবীদের সঙ্গে খেলাধুলা করত আর নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করত। সমুদ্রের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে নতুন কিছু দেখতে ভালোবাসত। মা-বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন, ‘প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়, সবাইকে বন্ধু ভাবতে হয়, আর বিপদ থেকে দূরে থাকতে হয়।’
নীলার বান্ধবী ছিল ছোট্ট ডলফিন টুনি, ছোট্ট কাঁকড়া টিকটিক, আর রঙিন মাছ পুঁটি।
নীলা রঙিন গহনায় নিজেকে সাজাতে খুব ভালোবাসত। সমুদ্রের মুক্তো, প্রবাল আর ঝিনুক দিয়ে সে নিজেই নানা রকম অলংকার বানিয়ে নিত। তার সবচেয়ে প্রিয় গহনা ছিল- ছোট ছোট মুক্তো জুড়ে বানানো একটা চমৎকার হার। গোলাপি প্রবাল দিয়ে বানানো দুল, যা তার চুলের সঙ্গে দুলত। ছোট ছোট ঝিনুক আর নরম শৈবাল দিয়ে বানানো একটা সুন্দর মুকুট।
মৎসকন্যার সাজুগুজু দেখে একদিন তার বন্ধু ছোট্ট কাঁকড়া টিকটিক বলল, ‘নীলা, তুমি কি রাজকন্যা? প্রতিদিন নতুন নতুন গহনা পরো!’
নীলা হেসে বলল, ‘আরে না! আমি তো শুধু আমাদের সমুদ্রের উপহার দিয়ে নিজেকে সাজাই। তুমি চাও তো, তোমার জন্যও একটা গহনা বানিয়ে দেব!’
নীলা তার বান্ধবী ডলফিন টুনি, কাঁকড়া টিকটিক আর রঙিন মাছ পুঁটিকে ডেকে বলল, ‘আজ আমরা সবাই মিলে গহনা বানাবো! কেমন হবে?’
টুনি খুশিতে লাফিয়ে উঠল, ‘ওয়াও! আমি মুক্তো খুঁজে আনব!’
পুঁটি বলল, ‘আমি রঙিন প্রবাল খুঁজে আনব!’
টিকটিক বলল, ‘আমি ঝিনুক নিয়ে আসব! কিন্তু একটু সাহায্য লাগবে, কারণ ঝিনুকগুলো বেশ ভারী!’
সবাইমিলে খুঁজতে বের হলো। কিছুক্ষণ পর তারা এক জায়গায় জড়ো হলো। নীলা তার লেজের নরম স্পর্শে শৈবাল দিয়ে গাঁথুনি তৈরি করল। পুঁটি প্রবালের ছোট ছোট টুকরা এনে একটার সাথে একটা জুড়ে দিল। টুনি মুক্তো গেঁথে দিল। আর টিকটিক ঝিনুকের ওপর সুন্দর নকশা এঁকে দিল।
যখন সব তৈরি হলো, তখন নীলা বলল, ‘এবার সবার জন্য একটা করে গহনা! পুঁটি, তোমার জন্য গোলাপি প্রবালের মালা। টিকটিক, তোমার জন্য মুক্তোর ব্রেসলেট। আর টুনি, তোমার জন্য একটা দারুণ নীল ঝিনুকের মুকুট!’
সবাই মুগ্ধ হয়ে নিজেদের গহনা দেখছিল।
টুনি হেসে বলল, ‘আমরা কি এখন রাজপরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম?’
টিকটিক বলল, ‘তাহলে আমি সমুদ্রের রাজকাঁকড়া!’
সবাই হেসে উঠল।
একদিন সবাই মিলে সাগরের নিচে খেলা করছিল। হঠাৎ টুনি এক গুচ্ছ বুদবুদ বানিয়ে নীলার দিকে পাঠাল।
নীলা চমকে উঠে বলল, ‘আরে, এটা কী?”
টুনি হাসতে হাসতে বলল, ‘এটা হলো আমার ভালোবাসার বুদবুদ গিফট!’
টিকটিক বলল, ‘তাহলে আমার ভালোবাসা হলো একগুচ্ছ নরম শৈবাল!’ সে একটা শৈবাল নীলা ও পুঁটির মাথায় ছুঁড়ে দিল।
পুঁটি নাচতে নাচতে বলল, ‘আমি তাহলে তোমাদের জন্য একটা জলতরঙ্গের গান গাই!’
এরপর সে মুখ দিয়ে জলতরঙ্গের মতো শব্দ করল, আর সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল।
তারা দৌড় প্রতিযোগিতা করার মনস্থির করলো, যদিও সমুদ্রে কেউ দৌড়াতে পারে না। কিন্তু তারা লেজ নাড়িয়ে কে কত দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলো!
দৌড়াতে দৌড়াতে মানে সাঁতার কাটতে কাটতে নীলা ও তার বান্ধবীরা সাগরের একটু গভীরে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ তারা দেখল, এক বড় মাছ জালবন্দি হয়ে ছটফট করছে। সবাই ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু নীলা ভয় না পেয়ে ভাবতে লাগল কী করা যায়। সে টুনিকে বলল, ‘তুমি দ্রুত গিয়ে অন্য বড় ডলফিনদের খবর দাও!’
টুনি দৌড়ে গেল। নীলা আর পুঁটি একসঙ্গে চেষ্টা করল জালের গিঁট খুলতে। কিছুক্ষণ পর অনেক ডলফিন একসঙ্গে এসে তাদের সাহায্য করল। সবাই মিলে সেই মাছটিকে মুক্ত করল।
বড় মাছটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল, ‘তোমরা খুবই সাহসী এবং বুদ্ধিমান! বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে কাজ করলে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তোমরা আমার জীবন বাঁচিয়েছো। আমার বন্ধুদের ডেকে তোমাদের নিয়ে আজ রাতে আনন্দ করবো।’
সেই রাতে সমুদ্রের তলদেশে এক দারুণ উৎসব হলো। সবাই নাচল, খেলল আর গান গাইল। নীলা ভাবল, ‘প্রকৃত বন্ধু শুধু আনন্দ ভাগ করে না, একসঙ্গে শেখে, তৈরি করে আর যখন দরকার হয়, তখন একে অপরকে সাহায্যও করে। সেই থেকে মৎস্যকন্যা নীলা আর তার বান্ধবীরা আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠল।