শঙ্কর প্রসাদ দে :
সুখ দুঃখের এই মানব জীবনে যেটুকু নিষ্কলুষ আনন্দ পেয়েছি, তার সঠিক হিসেব হয়তো কখনোই করা যাবে না। তবে ম্যারাডোনার শৈল্পিক ফুটবল নান্দনিকতা যে আনন্দ দিয়েছে তার একটাই যুৎসই ব্যাখ্যা সম্ভব। আমার একমাত্র পুত্র সন্তানের মুখ দেখে যে খুশি হয়েছিলাম, তার হিসেব করা যাবে মাত্র একটি বাক্যে। সে মুহূর্তটি ছিল শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। অতঃপর ম্যারাডোনা। এই ছোটখাট অথচ প্রচ- শক্তিধর মানুষটি দিয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আনন্দ। যদ্দিন বেঁচে থাকবো, এ আনন্দ কখনোই ছাড়বে না। পেলের প্রতিক্রিয়া হয়েছে সুন্দরতম। স্বর্গে ম্যারাডোনার সাথে খেলার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে এই কিংবদন্তি মহত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই আকাক্সক্ষার মধ্যে আরো ফুটে উঠেছে, ক্ষুদ্র এই গ্রহের সীমা ছাড়িয়ে ম্যারাডোনার ব্রহ্মা- অস্তিত্ব। তিনি স্থান ও সময়ের সীমাকে অতিক্রম করলেন।
বিজ্ঞান যতদূর এগিয়েছে, তাতে অদ্যাবধি ব্রহ্মা-ের অন্য কোন গ্রহ উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। প্রাণের অস্তিত্ব থাকলেও মানুষের মতো উন্নত প্রজাতির অস্তিত্ব আছে কিনা তা আরো অনিশ্চিত। যদি থেকেও থাকে তাদের বিজ্ঞানের ভাষায় এলিয়েন বলা হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা মানুষের মতো উন্নত প্রজাতি বিশ্ব ব্রহ্মা-ে নেই।
এ পর্যন্ত ফুটবল প্রেমিকদের ধারণা, বিশ্ব ব্রহ্মা-ের অন্য কোথাও উন্নত এলিয়েন থাকলেও ফুটবলের মতো এমন নান্দনিক খেলা অবশ্যই নেই। পৃথিবীতে ফুটবল খেলা হিসেবে জন্ম নেয়ার মুহূর্ত বলে কিছু নেই। একজন বোদ্ধা বলেছিলেন, নারীÑপুরুষ নির্বিশেষে ফুটবল বা ফুটবলের মতো বস্তুকে জীবনে একবার লাথি দিয়ে দেখেনি এমন স্বাভাবিক মানুষ নেই। ফুটবলের আকৃতি ও গঠন এই উপমার আসল কথা। একটি জাম্বুরা অথবা একটি আপেলকেও বল হিসেবে খেলা যায়। বাচ্চারা বেলুন দিয়ে ফুটবল খেলে। কমলা দিয়েও ফুটবল খেলে। অবশ্যই এই গ্রহে সুন্দরতম খেলা ফুটবল। মানুষের সব’চে জনপ্রিয় খেলার নামও ফুটবল।
প্রযুক্তির কল্যাণে ম্যারাডোনার সেই বিস্ময়কর ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনার খেলাটি কতবার দেখেছি তার হিসেব নেই। হয়তো আরো শতবার দেখবো। কোটি কোটি মানুষ সেদিন খেলাটি উপভোগ করলেন। ম্যারাডোনা হাত দিয়ে গোল করেন। গোলরক্ষক শিলটন ছাড়া রেফারিসহ কোটি কোটি মানুষের চোখে ধরা পড়ল না এই যাদুকরী হাতের টোকা। চুরি বিদ্যাও যে বড় শিল্প হতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত। ‘হ্যান্ডস অব গড’ গোলটি। মাত্র পাঁচ মিনিট ব্যবধানে করা দ্বিতীয় গোলটি চিহ্নিত হয়েছে সর্বকালের সেরা গোল হিসেবে।
কোটি কোটি মানুূষ আছে যারা তাঁকে ডেকে থাকেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ বলে। এটাতো নিশ্চিত, এমন নির্মল আনন্দ অনাগত দিনেও আর কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না। অন্তত বর্তমান দু’ প্রজন্মের মানুষের মনে আবার ম্যারাডোনার সরাসরি খেলা দেখার বাসনা থেকেই যাবে।
ম্যারাডোনা লাতিন বৈশিষ্ট্যকেও ব্যক্তিগত জীবনে ধারণ করেছেন। ফুটবলের বাইরে তাঁর নানা কর্মকা- নিয়ে নানা কথা এসেছে। এসব নিয়ে বিতর্ক ও কম হয়নি কিন্তু তিনি এসব পরোয়া করেননি। ফকল্যান্ড নিয়ে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড বিরোধের জবাব দিয়েছেন ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ জয় করে। তাঁর বাহুতে আঁকা ছিলো চে-গুয়েভারার ছবি, কিউবার বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বন্ধু ছিলেন তিনি। এই বিপ্লবীর মৃত্যুতে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়েছিলেন কিউবার জনগণের পাশে। তাই কেবল ফুটবলের প্রেমে নয়, সামগ্রিক লাতিন বোধ থেকেই ম্যারাডোনার জীবনের প্রতি তাকাতে হবে। তবে এটা নিঃসন্দেহ যে, সবকিছু ছাপিয়ে ভক্তদের কাছে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ফুটবলকে ঘিরে, তাঁর জীবনযাপনও ছিলো তাদের কাছে আগ্রহের।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]