আরিফুল হাসান »
ক্লান্ত দেহটাকে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিয়ে আকাশ দেখছে রাজিন। আকাশ দেখা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। শরতের আকাশে শাদা শাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে। রাজিনের ইচ্ছে হয় সে ভেলায় চড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যায়।কিন্তু যেতে চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না। পুষ্পিতা তাকে যেতে দেবে না। সাপের ছোবলের মতো তার সারা অঙ্গে বিষ ছড়িয়ে দেবে। তারপর ওঝা হয়ে নিজেই ঝাড়বে। পালানোর পথ নেই তা রাজিন জানে। তবু মাঝেমধ্যে পালাতে চায়Ñপুষ্পিতার কাছ থেকে। এই বন্দিত্বের জীবন থেকে। অবশ্য বন্দিত্বটা সে নিজেই চেয়ে নিয়েছে। পুষ্পিতার কোনো আগ্রহই ছিলো না তার প্রতি। সেই লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতো পুষ্পিতার গোছল। শরীর ঢলে ঢলে পুষ্পিতা পুকুরে গোছল করে। তার ভরা শরীর উছলায় কালো জলে। গোসল শেষে ও জলের নিচে গা ডুবিয়ে বসে থাকে। মেক্সির বড় গলা জলেতে ফুলে উঠলে জোড়া চাঁদের মতো ভেসে ওঠে একজোড়া স্তন। রাজিন চোখ সরিয়ে নিতে পারে না। পুকুরপাড়ে নিজেদের নারকেল গাছের গোড়ায় বসে মোহচোখে দেখে এসব। পুষ্পিতা সায়া-মেক্সি তুলে পা মাঝে। হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত শাদা জমিন ভেসে ওঠে। কালো, কিছুটা কুঁকড়ানো পশম জলের সাথে লাই খেলে। রাজিন উত্তেজিত হয়। তার গাবগাছের পুকুর পাড়, ঘন শেওড়া ঝোপ আর ঝোপের ওপর পুরো স্বর্ণলতার আস্তরণ তাকে লুকিয়ে রাখে পুষ্পিতার দৃষ্টি থেকে। কিন্তু সে যে এসব দেখে তা জানাজানির অভাব থাকে না। পাড়ার মানুষ কানাঘুষা করেÑকি হইলো! সে তো ভাতিজা, আর পুষ্পিতা তো তার চাচি। যদিও এ সম্পর্ক পাড়ার শুধু, রক্তের নয়; তবু সম্পর্ক তো সম্পর্কই, নাকি? লোকজন লাজে জিব কাটে। রাজিনের মা চায় রাজিনকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে।
রাজিনের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই হাজার একুশ সালে। এখন সে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। অল্প কিছুদিন আগে ফার্স্ট ইয়ার সমাপনী দিয়ে তেরো পত্রের মধ্যে আটপত্রে ফেল করে কোনো রকম প্রিন্সিপালের পায়ে ধরে প্রমোশন নিয়েছে। তার বাবার ঘুম নেই প্রবাসের বিরাজ্যে। ছেলের এমন খারাপ রেজাল্ট আর চরিত্রের বখাটেপনার কথা শুনে পিতা তার দেশে এসে পড়তে চায়। কিন্তু দেশে আসলে খাবে কীভাবে? সম্পদ সবটা দিয়ে বিদেশ-বিরাজ্যে এসেছে। এখন ঋণফিন দিয়ে মোটামুটি সঞ্চয়ের পথে বাবা। কিন্তু সন্তানের এমন অধপতনের কথা শুনে ঠিক থাকে কেমনে? রাজিনের মা বুঝায়, এসব ছেলেমানুষের অভ্যাস। একদিন থাকবে না। আপাতত তাকে দূরে পাঠাতে চায় এইচএসসি পরীক্ষার পরেই। বাবাও সায় দেয়। সুযোগ পেয়ে রাজিন আরও একটি বছর পেয়ে যায় পুষ্পিতার সাথে মিশতে।
পুষ্পিতার বিছানায় পিষে যেতে যেতে রাজিন হাপায়। পুষ্পিতা ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে রাজিনের হা করা মুখ। যেনো নীল হাঙরের মতো তার ক্লান্তিটাকে গ্রাস করে। রাজিন আরও চাঙা হয়ে ওঠে। ওপর থেকে পুষ্পিতা গলেÑআরো জোরে, আরও একটু জোরে জোরে। কোমরের মাংসপেশি টান করে রাজিন খেলে। খেলতে খেলতে এক সময় পুষ্পিতা ভেঙে পড়ে রাজিনের বুকে। রাজিন ততক্ষণে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ঘুমায়। ঘুমন্ত রাজিনের কপালে চুমু দিয়ে পুষ্পিতা আবার তাকে জাগিয়ে তুলে। জাগিয়ে তুলে ভাগিয়ে দেয়। যাও, এবার আকাশ দেখো, যতো খুশি আকাশের শাদা মেঘ দেখো।
ঘাসে শুয়ে আকাশ দেখার মতো রাজিনের কল্পনার মেঘগুলো ছুটে। সে তাতে চড়ে বসেআছে। ও-কি, পাশাপাশি আরেকটি মেঘ। কে তাতে চড়া? সে কি পুষ্পিতা? তার আদরের পুষ্পিতা? ফলে মেঘে ভেসে পালাতে চাইলেও পুষ্পিতা তাকে ছাড়ে না। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে সবদিক থেকে। রাজিন ইচ্ছে করে ঝাঁপ দেয় মেঘের বাহন থেকে। সে পড়ে যায়, নিচে পড়তে পড়তে দেখে পুষ্পিতার আঁচল তার জন্য বিছিয়ে আছে। রাজিন ঝাঁপ দিয়েও মুক্তি পায় না। তিলে তিলে বেঁচে থাকতে হবে তাকে পুষ্পিতার সাথে।
এমন দিনটি একবারে আসেনি। প্রথম যখন মানুষ কানাঘুষা করে পুষ্পিতার গোসল দেখার বিষয়টি নিয়ে, বিষয়টি পুষ্পিতার কানেও যায়। সে নিজেও সচকিত হয়। হায়! হায়! জিব কাটে। কি নির্লজ্জরে ছেলেটা! আবার ছেলেটা বলতেও ভয় পায়। পুষ্পিতার বিয়ে হয়েছে ওই একই ইয়ারে পড়াকালীন। অবশ্য কলেজ দুটো দুজায়গায়, ভিন্ন। কিন্তু সমপাঠী তো। পুষ্পিতা লজ্জা পায়, লজ্জা পেয়ে হাসে। সে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। মনে মনে হয়তো কামনা করে রাজিনের ফর্সা বুক। কিন্তু সুযোগ হয় না। সুযোগ হয় না বললেও ভুল হবে; আাসলে সে ভাবেÑ সমাজ কী বলবে? এই সমাজের চিন্তায় সে তেরো দিন পুকুরে যায় না। আশ্চর্য, এই তেরো দিন রাজিনকেও পুকুরের ঘাটে দেখতে পাওয়া যায় না। পুষ্পিতা নিশ্চিত হয়Ñনা, একমাত্র তাকে দেখার জন্যই রাজিন পুকুরের ঘাটে যায়, Ñএটিও এক প্রকারের ভালোবাসা। অন্তত লুচ্চামি তো নয়।
পুষ্পিতার স্বামী বিদেশ থেকে এসে তেত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করে। করেছে তো করেছে তা আবার টগবগে ষোলোর রমণী। এ আগুনজ্বলা দীপে সে কতক্ষই বা টিকতে পারে। প্রথম তিন মাস ব্যর্থ চেষ্টায় পুষ্পিতাকে নিষ্ফলা রেখেই তার স্বামী বিদেশ চলে যায়। এবার সে নিয়মিত পুকুরের ঘাটে যায়। কারণে-অকারণে যায়। একটু বেশি সময়ই থাকে পুকুর ঘাটে। রাজিনও হাতে একটি মোবাইল নিয়ে গেম খেলার আড়ালে তাকে দেখে। এভাবে একদিন দুজন মুখোমুখি হয়ে যায় আর রাজিন জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন? ঝিলিক তুলে হাসিতে পুষ্পিতা ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে চলে যায়। পরদিন রাজিন আবার অপেক্ষা করে। পুষ্পিতা মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, কিছু বলে না। পলকেই পা বাড়ায় জলের ঘাটে। রাজিন অপেক্ষা করে। পুষ্পিতা কলসের ঘায়ে জলের বুকে বৃত্ত তুলে তুলে কোনো করুণসুরের গীত গায়। রাজিন উদ্ধার করতে পারে না তার ভাষা। ফেরার সময় রাজিন দেখে তার চোখ দুটি ভেজা, দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে নেমে এসে গালে লেগে আছে। রাজিন কিছু বলার ভাষা হারায়। রাজিনকে অতিক্রম করে পুষ্পিতা চোখের জল ওড়নায় মুছে ফেলে।
এভাবে চোখের জলে, বুকের অনলে রাজিনের প্রেম হয় পুষ্পিতার সাথে। পুষ্পিতাও ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে ওঠে রাজিনকে পাবার জন্য। সুযোগটা এসে যায়। রাজিনের বোনের বিয়ে। গায়ে হলুদের রাতে পাড়া-পড়শি সবাই এসে পড়ছে রাজিনদের বাড়ি। পুষ্পিতাও এসেছে। এসে চোখে ইশারা দিয়েছে তাকে অনুসরণ করতে। বিয়ে বাড়ির কোলাহলের ভেতর রাজিনের পালিয়ে যেতে কোনো সমস্যাই হয় না। পুষ্পিতার বুড়ো শ্বশুরÑ বধির এবং রাতকানা, একমাত্র সেই ঘরে আছে। শ্বাসনালির তীব্র শব্দ করে সে ঘুমোচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই কানের কাছে ড্রোন পড়লেও সে টের পাবে না। তাছাড়া বিয়ে বাড়ির ডিজে এমপ্লিফায়ার যার ঘুম ভাঙাতে পারেনি তার ব্যাপারে আর কোনো অনিরাপত্তা নেই।
সেদিনের সেই রাতটা রাজিনের অন্ধকারে কাটে। কোন দিকে কী এনে কীভাবে কী করা হলো তা রাজিনের জানা নেই। শুধু জানা আছে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে কীভাবে তাড়াহুড়া করে সে বিছানায় চলে গেছে এবং সারারাত তার চোখে ঘুম নামে নাই।
পরদিনও সে পুষ্পিতার বিছানায় যায়। মধ্যরাতে পুষ্পিতার শ্বশুর সবকিছুই শুধু জোড়া জোড়া দেখে। সুতরাং তাদের ভয়ের কারণ নেই। তাই ইদানিং সময় করে বিকেল-সন্ধ্যায়ও আসে। দেহের বৃষ্টিতে তারা ভিজে চুপসে যায়। আজ দুপুর বেলাটা অভাবনীয় ছিল। পুষ্পিতা গোসল করতে এসে রাজিনকে দেখে ডেকে ঘরে নেয়। একমাত্র পরিবারের সদস্য শ্বশুর গেছে নামাজে। এই অবকাশে দুজনে দুপুরের রোদ ভাঙে। রোদ ভেঙে ক্লান্ত হয় রাজিন। নদীর পাড়ে সবুজঘাসের বুকে শুয়ে আকাশ দেখে।