আরিফুল হাসান »
তার সাথে আবার কথা হবে ভাবিনি। অভাবিত সূর্যোদয়ের মতো সে যেদিন আমাকে দেখা দিলো তখন আমি ছিলাম অন্ধকার। দুপুরেও মুমূর্ষু ঘুমের থাবা দুচোখের কোণে সেঁটে বসেছিলো যার জন্য আমি ভাবতে পারিনি মেঘলার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। যাহোক, দেখাটা হলো। আমি ভাবলাম, আমি চাঁদ দেখছি না সূর্যোদয়? সে ভাবলো, এবার বোধয় দুপূরের সূর্যের মতো টগবগে জ্বলে উঠবো আমি। আমি ভাবলাম, যাহোক, দেখা তো হলো, এবার পালাই।
না, মেঘলা আমাকে পালাতে দেবে না, সে আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে এ কথা সে দিয়েছিলো দুপুরের লাঞ্চে। সেদিন শুক্রবার ছিলো। অফিসের ব্যতিক্রম কাজে আমি সেদিন অফিসে, সেও সেদিন অফিসে থাকবে ভাবিনি। যাহোক, দেখা হলো তার সঙ্গে। সে আমাকে লাঞ্চ করালো। দুটো ডিম আর পরোটার পর চা’র বিলটা আমি নিজেই দিয়েছিলাম। তারপর তার দেখা পাবার কথা ভাবছি। ভাবছি, কী সুন্দর শুক্রবার আজ। আহা, দিনটা মাটি হলো। এমন মৃত্তিকার ভেতর মায়াময় টান, আর কে দিতে পারেÑমেঘলা ছাড়া?
মেঘলা, আমার ভালোবাসার মেঘলা। তার সাথে আবার দেখা দেখা হয়ে যাবে আমি ভাবিনি। পরের বার যখন আমি তার থেকে পালাতে চাইলাম, দেখলাম অপলক লক্ষ শুধু আমি, ওই চোরা চোখ চাহনীর অগভীর অন্ধকার অতিক্রম করে আমার ভেতরের দৃষ্টিটা দেখতে চাইছিল আর আমি পালাতে চাইছিলাম যেনো মেঘে ঢাকা আকাশটার সমস্ত অন্ধকার আমি বহন করে ফিরছি সেই ঘুমের আগ থেকে এবং ঘুমের মধ্যে এবং যখন জেগে উঠি, যখন আমার সকালগুলো লেট হয়ে যায়, যখন আমি আকাশ দেখতে ভুলে গেছি, যখন দৃষ্টিকে সমান্তরালের অযোগ্য ভাবতে শিউরে উঠতে হয়, যখন সমকক্ষ হওয়ার মতো হায়েনা হয়ে উঠি, অথবা উর্ধ্বে উঠে নমনীয়Ñতখনও, তখনও ঘুম আমার ভেতর রাতকে প্রবাহিত করে আর আমি আর অন্ধকার প্রতিবিম্ব যখন অফিসে, কাজে, খাবার টেবিলে।
ক্যান্টিনে সেদিন ভিড় ছিলো। সম্ভবত তাকে দেখেও ভুলে গিয়েছিলাম। নাহয় এমন উ”চস্বরে তার পছন্দের বাক্যটা এভাবে শোনাতে পারতাম না যে কারণে সে দৃষ্টিতে গেঁথে রাখে আমাকে ও সমান্তরাল ঈর্ষা। আমি বলেছিলাম মেয়ে মানুষ দেখা ভালো। চোখের জন্য নিরাপদ। সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। আমি তার চোখে চোখ রেখে এতটাই উচ্ছসিত হয়েছিলাম যে মুহূর্তেই আত্মবিস্মৃত হয়ে অনুকরন শুরু করলাম। আমি আমার গুরুজির প্রিয় বাক্য ‘আমি তো মেয়ে মানুষ দেখার জন্যই বেঁচে আছি’ ছুড়ে দিলাম। হোসাইন কথাটা হয় হয় করে মেনে নিলো। আমি দেখলাম, হোসাইনের চোখ চকচক করছে।
আমি বুঝতে পারছিলাম, তার সাথে তর্ক করা যায় না; তাই চুপ করে ছিলাম।
মেঘলার জন্য আমি যতক্ষণে ভাবছি ততক্ষণে সে ক্যান্টিন থেকে চলে গেছে। শেষবার চোরা চোখে দেখছিলাম তাকে। সেও আমাকে চট করে দেখে নিলো। তারপর ম্যাজিকের মতো কীভাবে কখন পালালো, আমার অনন্ত ঘুম তা দৃশ্য করতে পারেনি। একটা হাহাকারের মতো ক্যান্টিনের সবকিছু শূন্যতায় নাই হয়ে গেলো। কই গেলো, কখন গেলো মেঘলাÑআমি তা ভাববো কেনো?
মঘলা হয়তো আমার কাছে ওরকমটা আশা করেনি। শুক্রবারে ওর লাঞ্চট্রিট শেষ হলে সে যখন ফিরে যাচ্ছিল, যেতে যেতে বলেছিল কফিটা একদিন চেয়ে খাবো—সেদিন সে আমাকে বিশ্বাস করেছিল। বিশ্বাস করেছিলাম আমিও। নাকি বিশ্বাস করিনি, বিশ্বাসের ঘরে কেবল অভিনয়ই করেছি।
তারপর থেকে যতবারই মেঘলার সাথে আমার দেখা হচ্ছিল তার সাথে কফি পানের নেশাটা আমার কেটে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখছিলাম মেঘলার সাথে আমি টিএসসিতে হাঁটছি। শান্ত নিরিবিলি টিএসসি। শীতের পাতারা ঝরছে। টুপটাপ। পা মিলিয়ে চলছি আমরা। যেনবা উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন, কেনো হাঁটছি জানি না। টুকটাক কথা হচ্ছে আমাদের। মেঘলা বলছে, কী, হাঁটবে না? আমি পায়ের ব্যাথা দেখিয়ে দিলে মেঘলা জানালো সেও এক্সিডেন্ট করেছে কদিন আগে। আমারা হাত-ধরাধরি থেকে টুটো হাত দুটো হাতের উপর রাখলাম। একটি বেঞ্চে বসলাম জড়িয়ে। লতা হয়ে, শীতের ঝরা পাতা হয়ে নির্বোধ সময়গুলো গড়িয়ে যেতে থাকলো। আমাদের ভেতর শিশির পড়ছে। আমরা আবার হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেনো চলে যাচ্ছি নিজেও জানি না। টিএসসির পথটা হঠাৎ উধাও বনের পথ হয়ে গেলো। আমি দেখতে থাকলাম, এ পথের যেনো শেষ নেই। মেঘলা দেখতে থাকলো, আমিই যেনো তার একমাত্র পথ।
ক্রিয়েটিভে এরকম স্বপ্ন দেখা অন্যায়। তাই মেঘলা তার নিজের অবয়বটা আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়েছে যেনো আমি শাস্তি পাই প্রেমের আর সে অফিসের।
তখন থেকে তাকে খুঁজছি। হোসাইনকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে পারিনি। আপন অনিচ্ছায় গিয়ে বসেছিলাম। বসতে বসতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম হয়তো। হয়তো আমাকে অস্থির করে দিয়ে সেও হাঁপিয়ে উঠেছিল। দেখেছিলাম, মেঘলাকে দেখে সেও মাতাল হয়ে গেছে। কী করে বুঝাই, এ নেশার সারাব আমিও পানের তৃষ্ণায় বহুদিন আছি।
মেঘলার সাথে সেদিন বেশিই চাপা মেরে ছিলাম। আসলে মেয়ে মানুষ দেখার জন্য জীবন বিষয়ক যে দার্শনিক সত্যÑতা আমার অর্জন করতে বাকি ছিলো তাই গুরুর প্রিয় বাক্যের অনুকরণ করেছি মাত্র কিন্তু অনুসরণ করতে পারিনি এর মর্মার্থ। তিনি যেমন সসত্যে বলেনÑমেয়েরাও হেসে ওঠে ফুলের মতো। মেঘলাকে সেদিন হাসতে দেখিনি। তার চোখে তাজ্জব হয়ে যাবার অবাক হত্যা দেখেছি। যেনো দৃষ্টির বিষে সে আমাকে নীল করে দিচ্ছে। ছি: তুমি এত খারাপÑহয়তো সে ভাবছে আমাকে। আমি ভাবছি, কী বলছি এসব। আমি তো গুরুর সমকক্ষ নই। তাই হোসাইনকে ধমকাতে লাগলাম, অবশ্য মৃদু স্বরে। এসবকে ধমক ভাবলে ধমক, আবার পরামর্শ ভাবলে পরামর্শ। আমি বলছিলামÑএসব কর্পোরেট অফিসে এসব লাউড করা যাবে না। হোসাইন আমার কথার প্রতিবাদ করে উঠলো। বালখিল্যতা এ যে! আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম। হোসাইন বললো, সে বিয়ে করলে পাঁচ সন্তানের বাবা হতে পারতো। আমি হোসাইনকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বয়স কত? হোসাইন বললো, ত্রিশ।
মেঘলার ক্ষেত্রে আমি ওকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতে পারি না ঠিক আছে। কিন্তু মেঘলা আমাকে কী ভাবছে তা আর জানতে বাকি ছিল না। সে এখন হেসে হেসে আমাকে খুন করে। আমার চোখের সামনে থেকে গোলাপ ছিড়ে খোঁপায় গুঁজে, না না, সে নিজেই গোলাপ হয়ে সুঘ্রাণ ছড়ায়। অফিসের প্রতিটা কোণ মোহনীয় হয়ে উঠে। ক্রিয়েটিভের তিনশো ছাপ্পান্নজন কর্মী প্রাঞ্জল হয়ে উঠে। এতই প্রাণ¥য়তা মেঘলাÑযে আজ অফিসটা ক’দিন ধরে আলো হয়ে আছে।
শুধু আমার সাথেই মেঘলার আড়ি। সে আর আমাকে চেনে না। আমি চাতকের মতো তার মুখ দেখার জন্য অফিসে যাই। তৃষ্ণা নিয়ে ফিরি। সে আমাকে আড়াল করে। যেনো দেখেও দেখে না। কিন্তু সে হাসে। সে হাসি আমার অন্তরে কান্নার খরস্রোতা বহায়। বাঁকে বাঁকে আমি বাঁধা পড়ি দুখের নোঙরে। জলের ঢেউ পাক খেয়ে উঠে দুলিয়ে দিতে চায় আমার নৌকো। আমি সামলে থাকি। দাড় ধরে টানটান থাকি। আমার বুকের মধ্যে উড়ে চলে পালের বিস্তার। জলের গভীরে ছায়া ফেলে আকাশ আর মেঘ।