হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
মহান আল্লাহ্র জন্য নিবেদন করি, সমস্ত প্রশংসা, যিনি সমগ্র জাহানের পালনকর্তা। তাঁর তাসবীহ বা পবিত্রতা, যিনি প্রতিটি বস্তুদ্বারা প্রশংসিত। সবকিছুই তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি কৃতজ্ঞ বান্দার নে’মাত বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই। তাঁর কোন শরীক নাই। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সমগ্র সৃষ্টিকুল তাঁরই মুখাপেক্ষী। আমাদের হেদায়তের দিশারী, মুক্তির কা-ারী সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল।
আমাদের জানা আছে, হজ্ব দৈহিক ও আর্থিক উভয় প্রকার ইবাদতের সমন্বিত প্রয়াস। ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্যতম। অর্থব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় বিত্তহীন মুসলমানদের অনেকেই হজ্বের সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত। তবে, যাদের ভাগ্যের তারা জেগে ওঠে, আর্থিক অসামর্থ হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই আল্লাহ্র ঘর চাক্ষুষ করে নয়ন সার্থক করেন। হজ্বের মওসুম বিদ্যমান। তাই বিষয়টি প্রাসঙ্গিক বিচেনায় এর বিভিন্ন দিক চর্চাও সমীচিন।
সুরা বাকারার ১৯৬তম আয়াত হতে টানা ৮টি আয়াতে হজ্বের ও ওমরার বিভিন্ন প্রসঙ্গ বিস্তৃতি পেয়েছে। তন্মধ্যে ১৯৭ তম আয়াতটি আজকের খুৎবায় বিষয়বস্তু রূপে চয়নকৃত। আল্লাহ্ তাআলার ইরশাদ, ‘হজ্ব (আদায়ের সময়কাল) কয়েকটি সুবিদিত মাস। মাসগুলোতে (হজ্বের নিয়ত করতঃ ইহ্রাম নিয়ে) যে ব্যক্তি নিজের ওপর হজ্ব অপরিহার্য করে নেয়, তবে হজ্ব পালনকালীন তার জন্য না সম্ভোগধর্মী স্ত্রীÑ নৈকট্য বৈধ, না কোন গুনাহ্র কাজ, না কোন ঝগড়াÑবিবাদ। আর তোমরা যা পুণ্যকাজ সম্পাদন করো, আল্লাহ্ তা জানেন। আর তোমরা রসদ নিয়ে যেও। নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় হল তাকওয়া। হে বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিরা, তোমরা আমাকে ভয় করো’। হজ্ব ও ওমরার বিধিবিধান আয়াতগুলোতে বর্ণিত হলেও এখানে মূলতঃ ইহ্রাম অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিষিদ্ধতার কথাই বর্ণিত হয়েছে। হজ্ব বা ওমরা পালনের জন্য ইহ্রাম অপরিহার্য। আবার এখানে বর্ণিত যে কয়টি নিষেধাজ্ঞা, নিষিদ্ধ কাজ শুধু এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যেগুলোর অনুপুঙ্খ বিবরণ প্রিয়নবীর হাদীসসমূহে এবং ফিক্হ শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান। এখানে আলোচ্য আয়াতের প্রসঙ্গেই আলোকপাতের প্রয়াস বিধৃত। ইতোপূর্বে ১৯৬তম আয়াতে হজ্ব ও ওমরা পরিপূর্ণ করার নির্দেশ প্রদত্ত হয়। সেখানে কিছু নির্দেশনাও বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতটিতে শুধুমাত্র হজ্বের প্রসঙ্গই এসেছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা, যা ইহরাম অবস্থায় করা দ-নীয় তা উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ওমরায় করণীয় বিষয় মাত্র কয়েকটি। যেমন- ইহ্রাম, তাওয়াফ, সাঈ ও হলক (মাথা মুন্ডানো) বা চুল ছাঁটা। ওমরার জন্য সময় নির্ধারিত নয়। হজ্বে কিন্তু নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করতে হয়। এজন্যই বলা হয়েছে, হজ্বের কাজ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি মাসে সম্পন্ন করতে হয়। অজ্ঞতার যুগ থেকে এগুলোই হজ্বের সুনির্দিষ্ট ও সুবিদিত মাস। মাসগুলো হল, শওয়াল, যুল ক’দ ও যুল হজ্ব’র প্রথম দশদিন। এর কার্যক্রম মক্কা মুকাররামায় গিয়ে সম্পন্ন করা বিধেয় হলেও ইহ্রাম শওয়াল থেকেই নেওয়া যায়। এর পূর্বে হজ্বের নিয়তে ইহরাম নেওয়া জমহুর ওলামায়ে কেরামের মতে বৈধ নয়। অধিকাংশের মতে শওয়াল চাঁদ উদয়ের আগে কেউ ইহ্রাম নিলে তার হজ্বই আদায় হবেনা। আমাদের ইমাম আবু হানীফা (রহ.)র মতে আদায় হবে, কিন্তু মাকরূহ বা দূষণীয়। (মাযহারী)
আয়াতোক্ত তিনটি নিষিদ্ধ বিষয় হল, ‘রাফাস’, ‘ফুসুক’ ও ‘জিদাল’। (পবিত্র কুরআনে আগত আরবী শব্দত্রয়ের বাংলা শব্দে লিখিত উচ্চারণ)। হজ্ব পালনকারী ভাইবোনদের বিষয়গুলো জেনে নিয়ে সতর্কতার সাথে পরিহার করতে হয় বলে পুনরুক্তির ত্রুটি মার্জনীয়। ‘রাফাস’ একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। স্ত্রীÑমিলন, দাম্পত্য সম্পর্কের খোলাÑখুলি আলোচনা, উষ্ণÑসান্নিধ্য, যৌন উত্তেজক কথাবার্তা বা ঘনিষ্টতাÑএসবই রাফাস’র অন্তর্গত। যা ইহরাম’র হালতে নিষিদ্ধ। ‘ফুসুক’ সামগ্রিক পাপাচার ও গোনাহ্র অর্থে ব্যবহৃত। ইবনে ওমর (রাদ্বি.) এর ব্যাখ্যায় বলেন, যা ইহ্রাম অবস্থায় নিষিদ্ধ তাই ‘ফুসূক’। তাঁর মতে গোনাহ্র কাজ সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। এ দৃষ্টিকোণে, যে সমস্ত কাজ সাধারণভাবে নিষিদ্ধ নয়, তবে ইহ্রাম অবস্থায় নিষিদ্ধ, তাহলো ৬টি। যথা: (১) স্ত্রীÑসহবাস এবং তদসংক্রান্ত খোলাখুলি আলোচনা, (২) স্থলচর প্রাণি শিকার করা এবং এতে সম্পৃক্ত হওয়া, (৩) ক্ষৌরকর্ম ও নখÑচুল কাটা, (৪) সুগন্ধী ও প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার করা। এসব নারীÑপুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য ইহ্রামের হালতে হারাম। বাকি দু’টি শুধু পুরুষদের জন্যই প্রযোজ্য। সেলাই করা কাপড় পরিধান করা এবং মাথা, মুখম-ল আবৃত রাখা। ইহ্রাম অবস্থায় মহিলাদের চেহারা, বিশেষতঃ গ-দ্বয় আবৃত রাখাও নিষিদ্ধ, তবে পর্দা রক্ষার্থে ভিন্ন কিছুর সাহায্যে বা কারো আড়ে থেকে মুখ আড়াল করা উচিৎ। প্রয়োজনের বেশি গাইবে মুহ্রিম কারো সঙ্গে মেলা মেশা, ঘনিষ্টতা জঘণ্য পাপ। আর পুরুষদেরও মনে রাখা জরুরি যে, অমুহ্রিম কোন মহিলার অন্তরঙ্গতা অমার্জনীয় অপরাধ। তাদেরকে মনে করতে হবে, আল্লাহ্র হেরমে অবস্থানরত একান্ত তাঁরই দাসীÑবাঁদী। আর আহকামুলক হাকিমীন আল্লাহ্র একান্ত আত্মমর্যাদাবোধের সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখা অতি জরুরি।
৩য় শব্দটি হল ‘জিদাল’। যার অর্থ দ্বন্দ্ব ও বিবাদ। যখন দু’পক্ষ পরস্পরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করে। হজ্বের সময়কাল, আরাফাতের অবস্থান স্থল নিয়ে জাহেলী যুগে পারস্পরিক মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব চরম অবস্থায় উপনীত হত। কেউ চাইত আরাফাতে সমবেত হবে, পক্ষান্তরে অন্যেরা চাইত মুযদালিফায় বসে থাকতে। আবার এক পক্ষ যিলহজ্ব মাসে হজ্ব পলন করলে অপর পক্ষ পালন করতো যিলক্বদ মাসে। এ জাতীয় বিরোধপূর্ণ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে খোদায়ী নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে আরোপিত হয়েছে। বস্তুতঃ হজ্ব এমন এক ব্যাপক মহাসম্মেলন, যেখানে শ্রেণি, বংশ, কৌলিন্য, আভিজাত্যের ফারাক সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। অর্থ, বিত্ত, ধনÑ দৌলতের অহমিকা জলাঞ্জলি দিয়ে সবাইকে এক পোশাকে, এক বর্ণে, একই স্লোগানে, একই স্থানে এনে সমবেত করেছে। হজ্বের তাৎপর্যের মধ্যে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটা উপলব্ধি না হলে নিরর্থক হবে এ আয়োজনের। হজ্বের মধ্যে ৩টি ফরয। যথাÑইহ্রাম, ওকুফে আরাফা এবং তাওয়াযে যিয়ারাহ্। ‘ইহরাম্’ শব্দের অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধকরণ। ইহরাম অবস্থায় যেসব আচরণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তা নিজের ওপর হারাম করা হয় মূলতঃ নিয়্যতের মাধ্যমে। ইহ্রাম নিলে যে সমস্ত কাজ হারাম বা নিষিদ্ধ হয় তন্মধ্যে একটি, সেলাই করা পোশাক পরিধান করা। তাই, সাবধানতার জন্য আগেই তা পরিধান করা হয়। এটার কারণে ইহ্রাম’র কথাটি বিস্মৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ইহ্রাম পরিহিত হয়ে নিয়ত করা হয়। তা হল মুহরিম হিসাবে স্থির মতি হওয়া। ইহ্রাম’র জন্য জরুরি যে, তা মীকাত’র আগেই করে নিতে হবে। চাই ঘর থেকে হোক, বা পথিমধ্যে। কিন্তু মীকাতের বাইরে থাকতে হওয়া চাই। কারণ, ইহ্রাম বিহীন মীকাতের অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। যে প্রকার হজ্ব আদায় করার নিয়্যত করবে, তারই ইহ্রাম নিতে হবে। হজ্ব ৩ প্রকার। ইফরাদ (যার সাথে ওমরা নেই), তামাত্তু (যাতে কা’বা শরীফ পৌঁছে ১মতঃ ওমরা করে হালাল হবে, অর্থাৎ তাওয়াফ, সাঈ শেষে মাথার চুল মুন্ডন বা কর্তন করে ইহ্রাম মুক্ত হয়ে যাবে)। এবং ক্বিরান, যাতে ওমরা করার পরও ইহ্রামে থেকে হজ্ব শেষে হালাক্ব (বা চুল কেটে) করতঃ হালাল হবে। মক্কাবাসীরা শুধু ইফরাদ হজ্ব করবে।
এরপর ২য় ফরয ওকুফে আরাফা। যিলহজ্বের ৯ তারিখ সূর্যস্থির হওয়ার আগেই এখানে উপস্থিত হওয়া চাই। সূর্যাস্তের আগে আরাফাতের সীমা থেকে বাইরে আসা যাবে না। সূর্যাস্তের পর মাগরিব’র নামায না পড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। সে রাত মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও ইশার নামায পর্যায়ক্রমে পড়ে নিতে হয়। এখানে ফরয শুধু আরাফার অবস্থান। মুযদালিফার অবস্থান ওয়াজিব। এখানে নিবিষ্ট চিত্তে ইবাদত বন্দেগীতে রাত্রিযাপন করা উচিৎ।
এরপর ৩য় বা শেষ ফরয হবে তাওয়াফ। এটি হজ্বের প্রধান তাওয়াফ। যা যিলহজ্ব’র ১০, ১১ ও ১২ তারিখের সূর্যাস্তের আগেই সম্পন্ন করে নিতে হয়। তিনটি ফরযের কোন একটি গুরুত্বকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। ইহরাম দিয়ে সূচিত এ মহান ইবাদত। যে পোশাক মূলতঃ মৃত্যুর মহড়া। ইহরাম নামে শাদা কাপড়ে আবৃত হজ্ব পালনকারী দৃশ্যতঃ কাফন পরিহিত মৃত সদৃশ হয়ে মৃত্যুর মহড়া দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় সেই উক্তি, মৃত্যুর আগেই হও মৃতবৎ।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।