মোহাম্মদ নাজিম, হাটহাজারী »
প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী বাংলাদেশের মেজর কার্পজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। হালদায় প্রতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয় কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন মৌসুম। পরিবেশ অনুকুলে না থাকায় এপ্রিল মাসের দুটি জো এবং মে মাসের পূর্ণিমার জো অর্থাৎ তৃতীয় জো (২ থেকে ৭ মে) অতিক্রম হলেও এখনো দেখা মিলছেনা কার্পজাতীয় মাছের কাক্সিক্ষত ডিম।
দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বেড়েছে তাপমাত্রা। কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কর্ণফুলী নদীতে কমেছে পানি প্রবাহ। এর প্রভাবে জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদীর লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে হালদা নদীতে। এই লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে হালদার কার্পজাতীয় মাছের বিভিন্ন স্পনিং গ্রাউন্ডে। বর্তমানে হালদার বিভিন্ন স্পনিং গ্রাউন্ডের পানিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক লবণাক্ততার উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম।
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, হালদার উজানে লবণাক্ততার উপস্থিতি ও মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য বৃহস্পতিবার (৪ মে) পূর্ণাঙ্গ জোয়ারের সময় হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ডসহ উজানের আলম্মেরকূম থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত নয়টি পয়েন্টের (আলম্মেরকূম, সাত্তারঘাট, কান্দরআলীহাট, নোয়াহাট, মাছুয়াঘোনা, নাপিতেরঘাট, আমতুয়া, রামদাশমুন্সিরঘাট ও মদূনাঘাট বড়ূয়াপাড়া) পানির নমুনা সংগ্রহ করে সরাসরি হালদা নদীতে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে হালদার পানিতে মা মাছের প্রজননের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্যারামিটার যেমন পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, টিডিএস, এবং তড়িৎ পরিবাহিতার মান স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক। ঐদিন বায়ুম-লের তাপমাত্রা ছিল (৩২ থেকে ৩৪.৫) ডিগ্রী সেলসিয়াস। উচ্চতাপমাত্রার ফলে পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের (২২ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) তুলনায় বেড়ে (৩১ থেকে ৩২.২) ডিগ্রী সেলসিয়াসে উন্নীত হয়। টিডিএস এর মান ৩০৯ থেকে ২০০০ পিপিএম এবং তড়িৎ পরিবাহিতার মান ৬২০ থেকে ৪০০০ মাইক্রোসিমেন্স/সেমি. এবং লবণাক্ততার মান ০.২ থেকে সর্বোচ্চ ২ পিপিটি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
হালদা নিয়ে পিএইচডি করা এই গবেষক বলেন, সর্বোচ্চ লবণাক্ততা রেকর্ড করা হয়েছে মদুনাঘাট হ্যাচারির বড়ুয়াপাড়ায় এবং সর্বনি¤œ আলম্মের কুমে। রামদাস মুন্সির ঘাট থেকে আমতুয়া হয়ে নাপিতেরঘাট পর্যন্ত ১ পিপিটি এবং এরপর থেকে কান্দরআলীহাট পর্যন্ত ০.৫ পিপিটি লবণাক্ততা রেকর্ড করা হয়েছে। স্বাদুপানিতে লবণাক্ততার স্বাভাবিক মাত্রা ০.৫ পিপিটি বা তার কম। কিন্তু হালদায় প্রাপ্ত লবণাক্ততা স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক। বিদ্যমান এই সাময়িক লবণাক্ততা কার্পজাতীয় মাছের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবেনা, কারণ মেজর কার্পজাতীয় মাছ সহজেই ৫ পিপিটি এমনকি সর্বোচ্চ ১৪ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। কিন্তু লবণাক্ততার মাত্রা সহনশীলতা সীমার বাইরে গেলে তা কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন আচরণে পরিবর্তন আনবে, যার ফলে স্পনিং কার্যকলাপ হ্রাস, বিলম্বিত স্পনিং বা স্পনিং সম্পূর্ণ অনুপস্থিত হতে পারে।
এই পরিবর্তনগুলির ফলে হালদা নদীর মেজরকার্প জাতীয় মাছের সামগ্রিক জনসংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু আশার বাণী হচ্ছে বৃষ্টি হলে লবণাক্ততাসহ অন্যান্য প্যারামিটার সমূহের মান আদর্শ মানের মধ্যে চলে আসবে। অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় অর্থাৎ বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে না আসায় চলতি পূর্ণিমার জো’তে (২ থেকে ৭ মে) মা মাছের ডিম ছাড়েনি। তবে পরবর্তী চতুর্থ জো অর্থাৎ অমাবস্যার জো (১৬-২১) মে, তা না হলে পরবর্তী জুন মাসের পূর্ণিমার জো (১-৬) জুন অথবা সর্বশেষ (১৫-২০) জুন অমাবস্যার জো’তে কার্পজাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়বে বলে জানান তিনি।
এদিকে হালদা নদীতে মা-মাছ ডিম দিতে পারে এমন আশায় নদীর পাড়ে অপেক্ষায় রয়েছেন ডিম সংগ্রহকারীরা। তারা ডিম ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষা করছেন। পাশাপাশি ডিমগুলো পরিচর্যা করার জন্য মাটির কুয়াগুলো সংস্কারের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। গতকাল বিকালে ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন, কখন নদীতে মা-মাছ ডিম দিবে আর আমার তা সংগ্রহ করবো সেই আশায় নদীর পাড়ে বসে আছি। এমনকি রাতে নদীতে ডিম সংগ্রহকারীরা পাহাড়া দিচ্ছেন। মা-মাছ ডিম দিবে সেই আশায় ডিম সংগ্রহকারীরা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।