হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলা সমস্ত প্রশংসার, সমস্ত বন্দনা-স্তুতির মালিক। তিনি মালিক সমস্ত ক্ষমতার, সমস্ত আধিপত্যের, সমগ্র সৃষ্টিজগতের। তিনি সত্য, তিনি পবিত্র, তিনি দয়াময়। তিনি ¯্রষ্টা, সর্বদ্রষ্টা, তিনি পালনকর্তা, রিয্কদাতা। কৃতজ্ঞতা সেই পরম দয়ালু মহান সত্তার, যিনি কৃতজ্ঞ-অকৃতজ্ঞ নির্বিশেষে প্রতিটি সৃষ্টির আজীবন রিয্কের যোগান দিয়ে যান।
আমাদের সর্বান্তকরণ স্বীকারোক্তি, তিনিই একমাত্র উপাস্য, পরম আরাধ্য। যাঁর কোন শরীক নেই, সমকক্ষ নেই। তিনি অনাদি, অনন্ত, অসীম কুদরতের মালিক তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নেই। আমাদের নির্ভুল পথদ্রষ্টা, সত্য ও সুন্দর’র সঠিক নির্দেশক, হাদীয়ে মাহ্দী, রাসূলে আরবী সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্ তাআলাই সর্বসময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। তাঁর দয়াতেই আমরা সৃষ্ট। আমাদের সমস্ত শক্তি তাঁরই প্রদত্ত। তাঁরই করুণায় আমরা সৃষ্টির সেরা। মানুষের মধ্যে কেউ ধনবান, কেউ ক্ষমতাবান, কেউবা জ্ঞানবান। আমাদের সবারই এটা মনে রাখা জরুরি যে, ‘মহাপ্রভু দিয়ে ধন, দেখে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ’? প-িত-মূর্খ সবারই অর্থের প্রয়োজন হয়, নয়তো চাহিদা মেটে না, জীবন চলে না। জগৎ সংসারে এটাই আপ্তবাক্য। তবে মনুষ্যত্বের জন্য শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য নয়, তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আরো কিছু করতে হয়। মানুষ শুধু খায় না, লজ্জা নিবারণের জন্য সে কাপড়ও পরে। মানুষই তার লজ্জা পোশাকে আবৃত করে। সামাজিক কর্তব্য মানুষেরই আছে। মানুষ শক্তি বলে যা খুশি করতে পারে না; বরং বিবেকের অনুশাসনে নিজেকে সংযত রাখে। মানুষই আগামী প্রজন্মের কল্যাণে কাজ করে যেতে চায়। মানুষই চায় আত্মার উৎকর্ষ। পরকাল সৌন্দর্যের জন্য পরহিতে ব্রতী হয়। লোভ, হিংসা জয় করার জন্য ধর্মÑকর্মে মনোযোগী হয়। সাধনার মাধ্যমে আত্মজয়ে প্রত্যয়ী হয়। সীমায়িত ক্ষুদ্র দেহাবয়বে এ মানুষটি সৃষ্টির লক্ষ্য বাস্তবায়নে হয়ে ওঠে ¯্রষ্টার প্রতিনিধি। ক্রমশ অধিকারী হয় মহাশক্তির। আল্লাহ্র এ প্রিয় সৃষ্টি মানুষই প্রমাণ করে, সে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’।
মানব সৃষ্টির এ মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সহায়তায় আল্লাহ্ তাআলা মানুষের কাছে তাঁরই তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত, তাঁরই সুরক্ষিত এক নিষ্পাপ শ্রেণির বান্দা মানুষেরই সমাজে প্রেরণ করেছেন। যুগে যুগে যাঁরা মানুষকে আল্লাহ্র পথে ডেকেছেন অহোরাত্র। ভোগবাদী পাপীষ্ট মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় ক্রোধোম্মত্ত হয়ে তাঁদের অনেককে হত্যাও করেছে। পক্ষান্তরে, তাঁদের আলোতে এসে সোনার মানুষেও পরিণত হয়েছেন অনেকে। এঁরা হেদায়তের পরম দিশারী মা’সুম নবী-রাসূলগণ। যাঁরা তাঁদের বাণী শিরোধার্য করে সাধনায় ব্রতী হয়েছেন তাঁরা আল্লাহ্ রাসূলের প্রিয়পাত্র আমাদের শ্রদ্ধেয় বরেণ্য অলি-আওতাদ।
পবিত্র কুরআন-হাদীসের বহু বর্ণনায় আসা তাঁদের অল্পবিস্তর ঘটনাবলি আমাদের জীবনে আচরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘পূর্ববর্তীদের ঘটনাসমূহে ওই লোকদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত ও নিদর্শনাদি, যাঁরা আখিরাতের আযাবকে ভয় করেন’। (১১:১০৩) পঠিতব্য খুৎবায় সংকলিত সুরা মুমিনÑর নির্দিষ্ট আয়াতটিতে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদের যা বলছি, তোমরা অচিরেই তা স্মরণ করবে। আর আমার বিষয় আমি আল্লাহ্র কাছে সোপর্দ করছি। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ বান্দাদের বিষয়ে দৃষ্টিবান’। (আয়াত-৪০) এ বাক্যটি হযরত মুসা (আ.)র প্রতি বিশ্বাসী একজন লোকের উক্তি। যে ঈমানকে গোপন করেছিল। সে ফিরআউনের সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। ফিরআউনের দরবারীরা যখন মুসা (আ.) কে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল, তখন সে এ অন্যায় সিদ্ধান্তে চুপ থাকতে না পেরে প্রতিবাদ করে উঠেছিল, বলেছিল, ‘তোমরা একজন লোককে শুধু এ জন্যই হতা করবে যে, তিনি একথা বলেছেন যে, আমার পালনকর্তা হলেন ‘আল্লাহ্’? অর্থাৎ আল্লাহর প্রভুত্ব ঘোষণাই কি মৃত্যুদ-ে দ-িত করার মত পাপ? এ বলে সে ফিরআউনের বলয় হতে বেরিয়ে যায়। ফিরআউন তাঁর খোঁজে লোক লাগায় কিন্তু ওয়াদামত আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করেন। পরবর্তী আয়াতে এ বর্ণনা আছে।
খুৎবায় নসীহত বা উপদেশ থাকা বাঞ্ছনীয়; বরং এটা খুৎবার মধ্যে মাসনূন বিষয়। একাধিক বিষয় আজকের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। যা মুসলিম মিল্লাতের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গঠনমূলক বক্তব্যই বটে। যেমন- ক. আল্লাহ্র বান্দাদের প্রতি জুলুম করা থেকে বিরত থাক। খ. ইয়াতীম অনাথের সম্পদ হরণ করা থেকে পালিয়ে বাঁচো। গ. মিথ্যার অনাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করো, কেননা, আখেরাতের দিন মিথ্যুকদের চেহারা বিকৃত হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করবে। ঘ. মাপ-ওজনে কম দেয়া হতে বিরত থেকো, এমনিভাবে ঙ. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, চ. মাদক সেবন এবং ছ. খেয়ানত বা আত্মসাৎ করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা ও বিরত রাখার নির্দেশনা।
বর্তমান সময়ে এ সমস্ত পাপ ও গর্হিত বিষয়াদি এত ব্যাপকহারে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে শেকড় গেড়েছে যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এগুলোই যেন সভ্য ও আধুনিক শিক্ষিত সমাজের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এসব ঘৃণ্য অপরাধের অক্টোপাস হতে বুঝি আমাদের আদৌ নিষ্কৃতি নেই। জুলুম, অনাথের সম্পদ হরণ, মাপে জোচ্ছুরি, মিথ্যাচার বা মিথ্যা সাক্ষ্যতে কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ ডেকে আনা, নেশার প্রতিযোগিতায় মাদক দ্রব্যাদির সয়লাব ডেকে আনা এবং হকদারের হক বিনাশ করা-এমন সব অভিশাপ সমাজ জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব অপরাধের নেপথ্যে কিছু অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে অহরহ। ছাপোষা, বিত্তহীন শ্রেণি নীতি বিকারের এ প্রতিযোগিতায় থাকলেও পেছনের কাতারে। দৈন্যের শিকার এরা শ্রেণি বিশেষের টোপ রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। কুরআন-হাদীসের দিক নির্দেশনা শুধু তাঁরা গ্রহণ করবেন- যাঁরা ধর্মপ্রাণ, খোদাভীরু বান্দা। কারণ, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তবে এটি নিরেট সত্য যে, ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজ জীবন কলুষমুক্ত করারই ধর্ম। ইসলামে একটি বাণী বহুল শ্রুত, ‘ইসলামে বৈরাগ্য নেই’। জগৎ ও জীবনকে বাদ দিয়ে ধর্ম পালনের কথা অন্তত ইসলাম বলে না। জাতীয় কবি নজরুলের উচ্চারণ, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়’-কথাটি আমাদের ধর্মেরই শাশ্বত আচার-নীতি। বিচার, আচার, ব্যবসা, সৎকার- কোথায় নেই এ ধর্মের আদেশ নিষেধ?
আমাদের নবীজির পূর্বে গত হয়েছেন অসংখ্য নবী রাসূল। নিজ নিজ গোত্র ও সম্প্রদায়কে সংশোধন করতে তাঁরা হিমশিম খেয়েছেন। তবুও জীবন বাজি রেখে তাঁরা আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন অতি নিষ্ঠা ও যতেœর সাথে। এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে খোদাদ্রোহী অবিশ্বাসীরা নবী রাসূলের অনেককে নির্মমভাবে শহীদও করেছে। তবুও তাঁরা সত্যের বাণী প্রচারে ক্ষান্ত হননি। এদের একেক সম্প্রদায় এক এক অনাচারে অভ্যস্ত ছিল। এদের শোধরাতেই নবী-রাসূলগণ নিজ যুগের শ্রেষ্ঠতম আদর্শবান, নীতিবান মানুষ হওয়া সত্ত্বেও পাপীদের অত্যাচারে এঁরা শাহাদতবরণ করেন। বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে।
হযরত শুয়াইব (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন মাদইয়ান নামক এক জনপদে। যা সিরিয়ার বর্তমান ‘মুআন’ নামী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল বলে অনুমিত। মাদইয়ান, ইবনে ইবরাহীম এর পত্তনকারী বলে এ নাম। এর অধিবাসীরাই সংক্ষেপে ‘মাদইয়ান’। তারা গাছপালার পূজা করত বলে তাদের ‘আসহাবুল আইকা’ বলা হয়। যার অর্থ জঙ্গলওয়ালা। এহেন শির্ক’র পাশাপাশি তাদের আরেকটি জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ ছিল তারা বেচাকেনায় মাপে, ওজনে কারচুপি করে লোক ঠকাতো। তাদের হেদায়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত নবী শুয়াইব (আ.) অতি প্রাঞ্জল ভাষী, সুললিত বাচনের বাগ্মী ছিলেন। তাই আমাদের প্রিয়নবী তাঁকে ‘খতীবুল আম্বিয়া’ (বা নবীকুলে প্রাঞ্জল বক্তা) বলে মন্তব্য করেছেন। (অনূদিত মা আরেফুল কোরআন দ্র.) নিজ সম্প্রদায়কে তিনি হেদায়তের ভাষণে বলেন, ‘হে আমার কওম, আল্লাহ্র ইবাদত করো। তিনি ছাড়া আমাদের কোনই উপাস্য নেই। আর পরিমাপে ওজনে কম দিওনা। আমি তোমাদের এখন ভালো অবস্থায় দেখছি, তবে আমি তোমাদের ওপর এমন একদিনের আযাবের আশঙ্কা করছি, যা পরিবেষ্টনকারী। হে আমার সম্প্রদায়, ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে মাপ-ওজান পরিপূর্ণ দিও। মানুষের জিনিসপত্রের ক্ষতি-সাধন করো না। আর পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে বেড়াবে না’। (১১:৮৪Ñ৮৫)
ব্যবসা-বাণিজ্য, ওজনে কম দেওয়া, লোক ঠকানো, মানুষের হক-এখানে বর্ণিত এ বিষয়গুলো নিছক জাগতিক; তবে বান্দার হক সংরক্ষণও দ্বীন ধর্মের বিষয় হিসাবে বিবেচ্য। সুরা শুয়ারায় প্রসঙ্গটির পূর্ণ উল্লেখ রয়েছে। সম্প্রদায়ের লোকেরা পয়গম্বরের সাথে বিরূপ আচরণ করে, তাকে ‘মিথ্যুক’ বলে ভর্ৎসনা করে। এর শাস্তি স্বরূপ তাদের ওপর মেঘের আযাব পাকড়াও করল। প্রচ- দাবদাহ থেকে স্বস্তি পেতে যখন কালো মেঘের ছায়ায় আসল, তখন পানির পরিবর্তে অগ্নিবর্ষণ হলে সবাই তারা জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। (রূহুল মাআনী) আল্লাহ্র শাস্তি কঠোর।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।