চট্টগ্রাম মহানগরীর আগামীর মাস্টারপ্ল্যান (২০২০-২০৪০)
মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে সদিচ্ছা থাকতে হবে : প্রফেসর নজরুল ইসলাম
মাস্টারপ্ল্যান পুরো নগরীর প্ল্যান, তা সকলকে মেনে চলতে হবে : স্থপতি জেরিনা হোসেন
সরকারি সংস্থাগুলো মাস্টারপ্ল্যান মেনে চলতে সবচেয়ে বেশি অনাগ্রহ দেখায় : অধ্যাপক রাশিদুল হাসান
ভূঁইয়া নজরুল »
চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যানে নর্দান হিল (উত্তরের পাহাড়) সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল। সেই পাহাড়গুলো কেটে বর্তমানে নাসিরাবাদ প্রপার্টিজ, সিটি করপোরেশনে ভিআইপি আবাসিক এলাকা, পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা এবং জাকির হোসেন রোডের উত্তরে আকবরশাহ রেলওয়ে হাউসিং, ফয়’স লেক এলাকায় লেকভ্যালি, রোজভ্যালি, লেকভিউ, পশ্চিম খুলশিতে জালালাবাদ, কৃষ্ণচূড়া ও গার্ডেন ভিউসহ অসংখ্য আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। সেই সব আবাসিক এলাকার অনুমোদনও মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দিয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক আমরা কি মাস্টারপ্ল্যান মেনে চলছি?
শুধু আবাসিক এলাকা নয়, নগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা যদি বলি তাহলে দেখা যায় ১৯৬১ মাস্টারপ্ল্যান, ১৯৬৫ সালে রিভিউও প্ল্যান, ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যান ও ২০০৬-২০০৮ সালের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের কোথাও বলা হয়নি ফ্লাইওভার কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা। নগরীর ট্রান্সপোর্টেশন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সম্পাদক প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া অনেক দফায় বলেছেন, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নতুন রাস্তার কথা। কিন্তু সেই রাস্তা নির্মাণ না করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে নগরীতে আগামীতে মেট্রোরেল নির্মাণের পথকে জটিল করা হয়েছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর, রেলওয়ে, সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সকল সরকারি সংস্থা প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে কি মাস্টারপ্ল্যানের গাইড লাইন অনুসরণ করেন? সিটি করপোরেশনে নামকাওয়াস্তে প্ল্যানিং বিভাগ থাকলেও বাকি সংস্থাগুলোর কোনোটিতে প্ল্যানিং বিভাগ নেই। প্ল্যানিং বিভাগ ছাড়া মাস্টারপ্ল্যানের দিক নির্দেশনা বুঝার ক্ষমতাও নেই। আর ফলশ্রুতিতে নগরী দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এবিষয়ে বাংলাদেশে নগর নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান ধারণ করার মতো দক্ষ জনবল কি সকল সংস্থাগুলোতে রয়েছে? শুধু দক্ষ জনবলই নয়, মাস্টারপ্ল্যান মেনে চলতে হবে এই সদিচ্ছা কি আমাদের রয়েছে? যতোদিন এই সদিচ্ছার জন্ম না নেবে, যতোদিন একজন সুপরিচালকের হাতে নেতৃত্ব না থাকবে ততোদিন মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন হবে না। প্ল্যান হবে কিন্তু সেই প্ল্যানের সুফল আসবে না।’
মাস্টারপ্ল্যান প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ( চুয়েট ) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ‘১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় একটি ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান ছিল। সেই মাস্টারপ্ল্যানে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন সময়ে কি করা প্রয়োজন সেই প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু আমরা তা মেনে চলিনি। এখন সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছি। তারপরও আমরা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। অর্থাৎ সঠিক সময়ে আমরা মাস্টারপ্ল্যান মেনে প্রকল্প গ্রহণ করছি না।’
মাস্টারপ্ল্যান পরবর্তী ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান ( ২০০৬-২০০৮) প্রণয়নের সাথে জড়িত বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে নগরী ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে ট্রান্সপোর্টেশন মাস্টারপ্ল্যান ছিল, কিন্তু কেউ তা অনুসরণ করেনি। ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে নগরীর ভূমির সাথে সমন্বয় করে কোন নালার গভীরতা কত হবে সেবিষয়ে গাইড লাইন ছিল। কিন্তু আমরা তা অনুসরণ তো করিনি, বরং চট্টগ্রাম ওয়াসা নিজেরা আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। এভাবে চললে কখনো মাস্টারপ্ল্যানের সুফল আসবে না।’
মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে কী বাধা ছিল ?
চট্টগ্রাম মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় কাজ করা বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যানে অনেকগুলো গাইড লাইন ছিল। কিন্তু সেই গাইডলাইনগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা ১৯৬৫ সালের রিভিউও প্ল্যানে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান যেভাবে আইনগত ভিত্তি পেয়েছিল ১৯৬৫ সালের রিভিও প্ল্যান সেই আইনগত ভিত্তি পায়নি। সবশেষে ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে অনেক বিষয় যুক্ত করা হলেও তা অনেক সংস্থা মেনে চলেনি।’
এই মেনে না চলার পেছনে সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলোর ভূমিকা বেশি ছিল জানিয়ে চুয়েটের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ‘সাধারণ মানুষ প্রকল্প গ্রহণ করতে কিংবা বাড়ি নির্মাণ করতে সিডিএ থেকে অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে মনে করেন আমরাই তো সরকারি প্রতিষ্ঠান আবার আরেক প্রতিষ্ঠান থেকে কেন অনুমোদন নিবো? আর এই কনসেপ্ট থেকেই মাস্টারপ্ল্যান সুফলতা পাচ্ছে না।’
তবে মাস্টারপ্ল্যান বুঝার মতো সংস্থাগুলোতে মানুষও প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন নগর পরিকল্পনাবিদ প্রফেসর নজরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সিডিএতে দক্ষ পরিকল্পনাবিদ রাখা প্রয়োজন। একইসাথে অন্যান্য সংস্থাগুলোতেও মাস্টারপ্ল্যান বুঝে কিংবা ধারণ করতে পারবে এমন লোক থাকা প্রয়োজন। তারা মাস্টারপ্ল্যানের গাইড লাইন অনুসারে প্রকল্প তৈরি করবে।’
এবিষয়ে স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘সিডিএ’র মতো একটি সংস্থায় যদি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্বে একজন প্রকৌশলী থাকে তাহলে কি সেখানে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হবে?’
সমাধান কোথায় ?
বর্তমানে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০২০-২০৪০ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এর আগে ১৯৯৫ সালে প্রায় ১২ কোটি টাকায় ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে এর মেয়াদ শেষ হয়। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে পরিকল্পনার কৌশল বিষয়ে চুয়েটের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ‘কয়েক বছর পর পর সরকারের অডিট বিভাগকে মনিটরিং করতে দেয়া প্রয়োজন। এতে জবাবদিহিতা থাকবে। একইসাথে সরকারের পরিকল্পনা বিভাগ থেকে চেক লিস্টের আওতায় মাস্টারপ্ল্যানটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা বিভাগে গেলে মাস্টারপ্ল্যানে কি আছে তা চেক করে নেয়া হয়।’
মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ না করার পেছনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এবিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত সময়ের মাস্টারপ্ল্যানগুলোর বড় সীমাবদ্ধতা ছিল কোন কাজ কোন সময়ে কে বাস্তবায়ন করবে এবিষয়ে কোনো গাইড লাইন দেয়া ছিল না। এবারের মাস্টারপ্ল্যানে তা যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে এর সুফলতা আসবে।’
সিডিএ’র বক্তব্য
নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান হলো পুরো নগরীর জন্য একটা। এটাই সবাই মেনে চলবে।’ কিন্তু এই মেনে চলার কাজটি অন্যান্য সংস্থাগুলো মেনে চলতে নারাজ। এবিষয়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএ’র উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান আমরা করার অর্থ এটা শুধু আমাদের সম্পদ নয়। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সকল সংস্থা তা মেনে চলবে। তবে কিভাবে মেনে চলবে সেবিষয়ে একটা গাইড লাইন দেবো। সেই অনুযায়ী তা বাস্তবায়িত হবে। আশা করছি এবার এর সুফল পাওয়া যাবে।’
উল্লেখ্য, উত্তরে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়ীয়া, পূর্বে সাঙ্গু নদীর মোহনা, হাটহাজারী ও পটিয়া এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের ১১৫২ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে সিডিএ এলাকা রয়েছে। এই এলাকায় যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে সিডিএ থেকে অনুমোদন নিতে হয়।