বিবিসি বাংলা »
বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত জাপানি সৈনিকদের দেহাবশেষ উত্তোলনের কাজ শেষ হয়েছে এবং এগুলো এখন যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে জাপানে নেয়ার পর তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সেখানেই ‘যথাযথ মর্যাদায়’ সমাহিত করা হবে ।
ময়নামতিতে সমাধি খুঁড়ে দেহাবশেষ উত্তোলনের কাজে নেতৃত্ব দেয়া লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অবসরপ্রাপ্ত) জানিয়েছেন মোট চব্বিশটি সমাধির মধ্যে তেইশটিতে কঙ্কাল, মাথার খুলি ও শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়সহ দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। অন্যটিতে কিছু পাওয়া যায়নি।
“বাংলাদেশের গ্রামে যারা কবর খননের কাজে পেশাদার তাদের এনে এ কাজে সহায়তা নিয়েছি। আমরা দেহাবশেষ তুলে দিয়েছি। জাপানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি ফরেনসিক টিম সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণসহ আনুষঙ্গিক অন্য কাজগুলো করেছে,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন।
বিশ্বজুড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের জন্য সমাধিক্ষেত্র প্রস্তুত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন।
এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার হিল্লোল সাত্তার বলছেন উত্তোলন করা দেহাবশেষগুলো জাপানে ফিরিয়ে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দিবে জাপান সরকার।
“জাপানে নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে পরের প্রজন্মের সাথে মিলিয়ে পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। এরপর তাদের যথাযথ মর্যাদায় সামরিক কায়দায় সেখানে আবার সমাহিত করা হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সমাধি খনন ও দেহাবশেষ উত্তোলনকাজে কাজ করেছেন সাতজন জাপানি প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশে একটি ফরেনসিক দল।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোঃ আমিরুল কায়ছার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন বিষয়টি তারাও অবগত রয়েছেন।
ওয়ার সিমেট্রি ও সমাধি খনন
কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দুরে বুড়িচং উপজেলায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত এই ওয়ার সিমেট্রি বা যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র।
সরকারি তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে এটি একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫ হাজার সৈনিক নিহত হন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে তখনকার বার্মা, ভারতের আসাম ও বাংলাদেশে মোট নয়টি যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশে এ ধরনের দুটি সমাধিক্ষেত্র তৈরি হয়েছিলো যার একটি ময়নামতি, আরেকটি চট্টগ্রামে। এর মধ্যে ময়নামতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত তখনকার ভারতীয় ও বৃটিশ সৈন্যদের সমাধিস্থ করা হয়েছিলো। এই সমাধিক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন।
এই সমাধিক্ষেত্রে মোট ৭৩৬টি কবর আছে বলে জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫৭ জন যুক্তরাজ্যের। এছাড়া তখনকার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে এলাকা সেই অবিভক্ত ভারতের ১৭৮ ও জাপানের ২৪ জনের সমাধিস্থল এটি।
এর বাইরে যাদের সমাধি আছে তাদের মধ্যে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন করে, নিউজিল্যান্ডের চার জন, রোডেশিয়ার( বর্তমানে জিম্বাবুয়ে) তিন জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ এবং তৎকালীন বার্মা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ডের আছেন একজন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যায় কম হলেও আসিয়ান দেশগুলোর এলাকায় বহু জাপানি সেনার সমাধিক্ষেত্র রয়েছে।
“মিয়ানমার ও ফিলিপাইন অঞ্চলজুড়ে এ ধরনের সমাধিক্ষেত্র গুলোতে প্রচুর জাপানি সেনাকে সমাহিত করা হয়েছিলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশ ও জাপানিদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। জাপানিরা সিঙ্গাপুর ও চীনের কিছু এলাকায় দখলের পর ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। জাপানিদের রেঙ্গুন দখলের পর বার্মা যুদ্ধে বহু সৈনিক মারা যায়।
সেই সময় যারা আটক হয়েছিল বা আহত অবস্থায় কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়েছিল, পরবর্তীতে তাদের মৃত্যু হলে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো।
কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বলছেন তার বাবা নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক ছিলেন। তাদের বাড়িও কুমিল্লায়। তিনি নিজেও কুমিল্লা সেনানিবাসে লম্বা সময় সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। ওয়ার সিমেট্রির স্থান নির্বাচনে তার বাবা কাজী আবদুল মুত্তালিবের ভূমিকার কথা জানা যায়।
“যুদ্ধে জাপানিরা ছিলো শত্রুপক্ষ। সেজন্য সমাধিস্থলের এক কর্নারে তাদের জায়গা দেওয়া হয়। যারা মুসলিম ছিলেন তাদের অন্য পাশে দাফন করা হয়। তবে এখানে যাদের সমাহিত করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য এসে মারা গিয়েছিলেন,” বলছিলেন তিনি ।
কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের কান্ট্রি ম্যানেজার হিল্লোল সাত্তার বলছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এখনকার বাংলাদেশ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র না থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দরে বোমা বর্ষণ হয়েছিলো।
“পাশাপাশি অন্য জায়গায় আহতদেরও অনেককে চিকিৎসার জন্য ফিল্ড হাসপাতালে আনা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের ওয়ার সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কেন দেহাবশেষ নিচ্ছে জাপান
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক থেকেই ওই যুদ্ধের সময় বিশ্বজুড়ে নিখোঁজ জাপানি সৈন্যদের খুঁজে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠতে থাকে।
তখন প্রায় চব্বিশ লাখ জাপানি সেনা যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলো এবং এর অর্ধেকই আর ফিরে যায়নি। যুদ্ধে জাপানের পরাজয় হলেও পঞ্চাশের দশকে বিশ্বজুড়ে সমাধিস্থ হওয়া সৈনিকদের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠতে থাকে।
বিশেষ করে কনজারভেটিভ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল কয়েক দশক ধরেই এ দাবিটিকে উপজীব্য করে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে আসছিলো এবং পরে এটি বেশ জনপ্রিয় দাবি হয়ে উঠলে দৃষ্টি দেয় জাপান সরকার।
শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে এসে জাপান পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয় যার লক্ষ্য হলো ২০২৪ সালের মধ্যে জাপানের বাইরে থাকা জাপানি সৈন্যদের দেহাবশেষ উদ্ধার ও জাপানে ফিরিয়ে নেয়া।
তবে এর আগে যেসব পরিবারের সেনারা নিখোঁজ ছিলো তাদের অনুরোধে ডিএনএ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় জাপান সরকার। ২০২৩ সালের জুলাইতে জাপান হারানো সৈন্যদের দেহাবশেষ বিষয়ক সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র চালু করে, যারা ডিএনএ পরীক্ষার দায়িত্ব পায়।
এর আগে ১৯৪৩ সালে প্যাসিফিক অঞ্চলে মারাত্মক বিপর্যয়ের পর সামরিক বাহিনী নিহতদের পরিবারে শুধু পাথর ভর্তি বাক্স পাঠিয়েছিলো। যার অর্থ, তাদের পরিবারের সদস্য সৈনিক মারা গেছে। তখন আর কোন তথ্য পরিবারগুলোকে দেয়া হয়নি।
পরে ১৯৫২ সালে জাপান একটি দল পাঠালেও এশীয় দেশগুলো তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ এসব দেশ জাপানি আগ্রাসনের শিকার হয়েছিলো।
তারপরেও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার সেনার দেহাবশেষ ফেরত নেয়া হয়েছিলো বিভিন্ন দেশ থেকে। এরপর ওই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে আবারও আহত ও নিহতদের পরিবারের দাবির মুখে চালু করা হয়।
সরকারি এই মিশন শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ ৪০ হাজার দেহাবশেষ উদ্ধার করে যা টোকিওর চিদরিগাফুছি ন্যাশনাল সিমেট্রি অফ আননোন সোলজারস-এ রাখা হয়েছে। তাদের কখনো ডিএনএ টেস্ট হয়নি বা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কিন্তু এখন যাদের দেহাবশেষ নেয়া হচ্ছে সেগুলো জাপানে নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের সাথে ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে এবং এরপর পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হবে।
হিল্লোল সাত্তার বলছেন, “জাপানে এ নিয়ে একটা মুভমেন্ট হচ্ছে ত্রিশ বছর ধরে যে কেন আমাদের সৈন্যরা বাইরে পড়ে থাকবে। তারা ভারত থেকে নিয়েছে এরই মধ্যে। লাওসসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকেও নিয়ে যাচ্ছে”।
লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অবসরপ্রাপ্ত) বলছেন জাপান কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে ময়নামতি সিমেট্রি থেকে জাপানিদের দেহাবশেষ উত্তোলনের জন্য তার সাথে যোগাযোগ করে।
“এরপর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু পরে হলি আর্টিজানের ঘটনায় জাপানি অনেকে নিহত হলে এ উদ্যোগ থেমে যায়। এরপর গত বছর তারা আবার যোগাযোগ করে। শেষ পর্যন্ত ১৩ই নভেম্বর সমাধি খনন শুরু করে দেহাবশেষ উত্তোলনের কাজ শুক্রবার আমরা শেষ করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
তিনি জানান মোটামুটি ৯৬ শতাংশ দেহাবশেষ তারা পেয়েছেন খনন করা সমাধিগুলো থেকে।